নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় নির্বাচনের দিন ছাড়া বিএনপি কোনোভাবেই গণভোটের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সালাহউদ্দিন আহমদ, নজরুল ইসলাম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বিএনপি জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি রচনা এবং জনগণের সম্মতি নেওয়ার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোটের প্রস্তাব করেছিল। ২০২৬ সনের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তাবিত গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।’
‘সময় স্বল্পতা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সূচনা হয়। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কারের জাতীয় প্রত্যাশা এবং শহীদদের আকাঙ্ক্ষা পূরণের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়।
রাষ্ট্র কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কার বিএনপির অন্যতম এজেন্ডা এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর আগেই বিএনপি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে জাতির সামনে ৩১ দফা উপস্থাপন করে। তার আগে ২০২২ সালে ২৭ দফা এবং ২০১৭ সালে ভিশন-২০৩০ প্রকাশ করে। অতএব, বিএনপি এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তি ও শক্তিসমূহ জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সার্বিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করে আসছে। সুতরাং, রাষ্ট্র কাঠামোর প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংস্কার বিএনপির অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা।’
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোকে বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সংস্কার কমিশনগুলোর কাছে আমরা সংবিধান, বিচারবিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের দলের পক্ষ থেকে বিস্তারিত মতামত দিয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহও তাদের মতামত দিয়েছে। পরবর্তীতে উক্ত ছয়টি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আমাদের এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ আলোচনা হয়। ছয়টি সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রণীত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ওপরই দফাভিত্তিক আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সমস্ত আলাপ-আলোচনার ফলস্বরূপ প্রণীত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়, যার সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা।
‘ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, যে সমস্ত বিষয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে একটি জাতীয় সনদ প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হবে। পরবর্তীতে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সেই সনদের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে। তিনি জাতির উদ্দেশে দেওয়া বিভিন্ন ভাষণেও তার এই বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে পুনঃব্যক্ত করেছেন। জুলাই ঘোষণাপত্রেও এই বক্তব্য উধৃত হয়েছে।’
ঐকমত্য হওয়া কয়েকটি দফায় অগোচরে পরিবর্তন এনেছে কমিশন
ঐকমত্য হওয়া কয়েকটি দফায় ঐকমত্য কমিশন অগোচরে পরিবর্তন এনেছে দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনায় কিছু কিছু বিষয়ে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্ট সহকারে ঐকমত্য হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ যেভাবে প্রণীত হয়েছে, তাতে নোট অব ডিসেন্টের অংশে এই বক্তব্য স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, ভিন্নমত/নোট অব ডিসেন্ট প্রদানকারী কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা সে মতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
‘১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এক ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা কেবলমাত্র আলোচনার মাধ্যমে প্রণীত সনদের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছি। কিন্ত ওই দিনে জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত কপি আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। পরবর্তীতে প্রিন্টেড পুস্তক হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের কপি হাতে পাওয়ার পর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা আমাদের অগোচরে পুনরায় সংশোধন করা হয়েছে।
‘যেমন: ক। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি অফিসে টাঙ্গানো সংক্রান্ত বিধান (অনুচ্ছেদ ৪ (ক) বিলুপ্ত করার বিষয়টি সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সম্মতিপত্র দিয়েছে। খ। সংবিধানের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদ (পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম তফসিল) পুরোপুরি বিলুপ্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের বিষয়ে প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সম্মতি প্রকাশ করলেও অগোচরে সেটা চূড়ান্ত সনদে সংশোধনী আনা হয়েছে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ২৮ অক্টোবর সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো চিঠিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টাও একজন দস্তখাতকারী বটে। ঐকমত্য কমিশন এবং সরকার একই অঙ্গ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। উক্ত পত্রে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে দুটি বিকল্প পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের এবং আইনগত ভিত্তি প্রদানের জন্য সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে।
“চিঠিতে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’ শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে। এরুপ প্রস্তাবিত আদেশের একটি খসড়া সংযুক্তি-২ এবং সংযুক্তি-৩ এ সংযোজিত করা হয়েছে। সরকারের এরকম আদেশ জারি করার এখতিয়ার নাই। সংবিধানের ১৫২ নং অনুচ্ছেদের সংজ্ঞা অনুসারে ‘আদেশ’ আইনের মর্যাদাপ্রাপ্ত, অতএব সেটি জারি করা রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার।”
ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ একপেশে ও জবরদস্তিমূলকভাবে জাতির ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিকল্প প্রস্তাব ১ এ সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। বিলের তফসিল-১ এ সংস্কার প্রস্তাবসমূহ সন্নিবেশিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে বিল সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হবে। বিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধান সংশ্লিষ্ট তফসিল-১ এ বর্ণিত ৪৮টি দফার (জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত দফাগুলো) ওপরে গণভোট হবে। উক্ত দফাসমুহের বিপরীতে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহের মতামত, ভিন্নমত, নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব এবং সুপারিশ একপেশে ও জবরদস্তিমূলকভাবে জাতির ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তাহলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, দীর্ঘ প্রায় ১ বছরব্যাপী সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলসমূহের দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনা ছিল অর্থহীন, অর্থও সময়ের অপচয়, প্রহসনমূলক এবং জাতির সঙ্গে প্রতারণা।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং সে কারণে সংলাপের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন ভিন্নমত পোষণে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকারকে আমলেই নেয়নি। উক্ত বাস্তবায়ন আদেশে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একইসঙ্গে একটি “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” গঠিত হবে। এবং তারা আলাদাভাবে সংসদ সদস্য এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ সদস্য হিসেবে শপথ নিবেন। অর্থাৎ নির্বাচিত জাতীয় সংসদটি একই সঙ্গে “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” হিসেবে অভিহিত হবে। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদ এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত; সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত ছিল না, আলোচনার জন্য উপস্থাপিত হয়নি, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হওয়ার অবকাশও ছিল না। এ জাতীয় কোন সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করতে হলে তাও পরবর্তী জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
‘বলা হয়েছে উক্ত বাস্তবায়ন আদেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায় তাহলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠান হওয়ার পূর্বেই এই ধরণের pre-emptive পদক্ষেপ আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হাস্যকর। জাতীয় সংসদে অনুমোদনের পর যে কোনো বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদনপ্রাপ্তির পরই কেবল আইনে পরিণত হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এবং তা গণতান্ত্রিক রীতি ও সংসদীয় সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। বিকল্প-২ প্রস্তাবে জুলাই সনদ আদেশের বিষয়টি বিল আকারে না দিয়ে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত প্রস্তাবসমূহ সরাসরি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও ঐকমত্য কমিশনের আলোচনাকালে বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিকদলসমুহ কর্তৃক প্রদত্ত মতামত, ভিন্নমত ও নোট অব ডিসেন্ট গণভোটে উপস্থাপনের সুযোগ রাখা হয়নি।’
 
						 
			