আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে দীর্ঘ সময় হয়রানির শিকার হওয়া ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সংখ্যাগরিষ্ঠ হুইপ ডিক ডারবিন। সিনেটে দেয়া ভাষণে তিনি ড. ইউনূসের প্রতি এই সমর্থন ব্যক্ত করেন সোমবার। তার নিজস্ব ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে তিনি নিজেই জানিয়েছেন এসব কথা। এতে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনাকে তিনি সাবেক স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, তার পদত্যাগের পর সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে এসেছেন নোবেলজয়ী ড. ইউনূস। তিনি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি নিয়ে সারাজীবন যে কাজ করছেন তার বিস্তারিত সিনেট ফ্লোরে তুলে ধরেন ডিক ডারবিন।
ড. ইউনূসের এসব কর্মসূচি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিম্ন আয়ের মানুষদের দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করেছে। ড. ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রথম সফরে প্রথমবার সাক্ষাতের বিষয় ভাষণের শুরুতে তুলে ধরেন ডিক ডারবান। তিনি বলেন, ওই সফরের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির একজন প্রফেসরের (ড.ইউনূস) সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন চমৎকার চরিত্রের একজন মানুষ। তিনি এমন একটি তত্ত্ব নিয়ে সামনে এগিয়েছেন, যা পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র মানুষগুলোকে সহায়তা করবে।
এর নাম ক্ষুদ্রঋণ। তিনি ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ নামে জনগণের একটি ব্যাংক সৃষ্টি করেছেন। তিনি এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, পৃথিবীতে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষগুলোকে আপনি ক্ষুদ্র পরিমাণে ঋণ দিয়ে তাদের জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারেন। ঋণ নিয়ে তারা তা ফেরত দেবেন। এর মাধ্যমে তারা অধিক গঠনমূলক ও অধিক লাভজনকভাবে সামনে এগুতে পারবেন।
ওই সফরের পর তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি আমরা। ডিক ডারবিন আরও বলেন, আমি মনে করি তিনি (ড. ইউনূস) ব্যতিক্রমী, অসাধারণ। তাকে এখানেও (যুক্তরাষ্ট্রে) স্বীকৃতি দেয়া উচিত। তাই প্রয়াত সিনেটর মাইক এনজি এবং কংগ্রেসম্যান রাশ হোল্টের সঙ্গে আমি উদ্যোগ নিলাম এই বিস্ময়রকর অর্থনীতির প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কংগ্রেসশনাল গোল্ড মেডেল দেয়ার। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি ‘গরীবের ব্যাংকার’ হিসেবেও পরিচিতি পান। তিনি ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা। এটা বিস্ময়করভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষদের সহায়তার একটি পদ্ধতি। তিনি স্বীকার করেন হাতে সামান্য পরিমাণ অর্থ থাকলেও মানুষ নিজেকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করতে পারে। ডিক ডারবিন আরও বলেন, তার গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি (ড. ইউনূস) প্রমাণ করেছেন যে, ক্ষুদ্রঋণ কোনোরকম গ্যারান্টার ছাড়াই দরিদ্র নারীদের মধ্যে বিনিয়োগ করতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংকের বেশির ভাগ ঋণ দেয়া হয়েছে নারীদের। তারা ভয়াবহ দারিদ্র থেকে ছোট ছোট ব্যবসায়ী হয়েছেন।
এরপর উগান্ডায় একজন নারীর ক্ষুদ্রঋণ নেয়ার কথা তুলে ধরেন ডিক ডারবিন। সেই নারীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। সেই কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, উগান্ডার এক ভাঙাচোরা কুড়েঘর সহ আমি এখন সারাবিশ্বে এই উদ্ভাবনী পদক্ষেপের ফল দেখতে পাচ্ছি। উগান্ডায় আমি তিনজন মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তারা স্থানীয় বাজারে কাজ করেন। তাদেরকে দোভাষীর মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- ক্ষুদ্রঋণ কিভাবে তাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। একজন নারী বললেন- আমার হাঁটু এখন নরম হয়েছে। তার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না। তাকে ব্যাখ্যা করতে বললাম। তিনি বললেন- ক্ষুদ্রঋণ আমাকে বাজারে একটা সুযোগ করে দিয়েছে। তা থেকে কিছু অর্থও বানাতে পেরেছি। এই ঋণ নেয়ার আগে আমার বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য হাঁটুর ওপর ভর করে ভিক্ষা করতাম। এখন আমাকে আর সেটা করতে হয় না। তাই আমার হাঁটু স্বস্তি পেয়েছে।
ডিক ডারবিন বলেন, ড. ইউনূসের ধারণা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। একই সঙ্গে এটা তাকে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ এনে দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, তার এই ধারণা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ক্রোধ এনে দিয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার ড. ইউনূসকে প্রশ্নবিদ্ধ আইনি অভিযোগে হয়রানি করেছে। তাকে জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়েছে। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় আগস্টে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। তার কয়েকদিন পরেই দেশে একটি নতুন নির্বাচনের জন্য ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। ডিক ডারবিন বলেন, গত মাসে আমার বিস্ময়ের ব্যাপারটা কল্পনা করুন! হাসিনা শেষ পর্যন্ত জনবিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেন। এই আন্দোলনের বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চেয়ে ভাল কেউ করতে পারবেন না। এই সেই অর্থনীতির প্রফেসর, যার সঙ্গে ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তার এই সুখবর শোনার পর তাকে ফোন করেছি। তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন এবং বিশ্বাস করেন যে, দেশের মানুষ এখন ঐতিহাসিক এক সুযোগের জন্য প্রস্তুত। তাকে আমার পূর্ণাঙ্গ সমর্থন জানাচ্ছি। তাকে বিশ্বাস করি আমি। ২০ বছর আগে যেমন বিশ্বাস করেছি, আজও তেমনি বিশ্বাস করি। পাশাপাশি আমি তাকে সমর্থন দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানাই। আমি জানি বাংলাদেশি জনগণের স্বার্থই ড. ইউনূসের হৃদয়ে। এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে তিনি সর্বোচ্চ করবেন।