https://www.a1news24.com
৭ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৩:৩৮

শিশু—কিশোরের হাতে স্মার্টফোন কতটা নিরাপদ?

“মুঠোফোনে বন্দী শৈশব”

 

আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে কিশোর অপরাধ

টি.আই সানি,শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিদিঃ রমজান মাস উপরক্ষে টানা চল্লিশ দিন স্কুল বন্ধ ছিল,আর এই শিশু কিশোরদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কোনও স্তরে যদি কোনও ঘাটতি থাকে, তাহলে সেটার নেতিবাচক প্রভাব শিশু—কিশোরদের ওপর পড়ে। শিশুরা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে অনুকরণ করতে। আর এই অনুকরণ সে তার নিজস্ব পরিবেশ থেকেই করে থাকে। তাই শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ যদি অনুকুল হয়, তাহলে সে সুষ্ঠভাবে বেড়ে ওঠে। আর প্রতিকূল হলে সে সমাজের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে।

তাই বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তির ওপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি অবশ্যই মানব কল্যাণ্যের জন্য এক বড় প্রয়োজন, কিন্তু এটা যে কখনো কখনো বড় বিপদের কারণ হতে পারে, সেদিকে আমাদের নজর মনে হয় একটু কম। প্রযুক্তির একটি বড় অবদান স্মার্টফোন। এই যন্ত্রটি ছাড়া আমরা এখন একটা দিনও কল্পনা করতে পারি না। এই যন্ত্রটি আমাদের অনেক কাজে লাগে বলেই এটার প্রতি আমাদের এত ঝোঁক। কিন্তু এই যন্ত্রটি একটি শিশু বা কিশোরের হাতে কতটা নিরাপদ? আমরা এমনিতেই মাদক নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি। কিশোর তরুণদের হাতে আজ মাদক তুলে দেয়া হচ্ছে। মাদক গ্রাস করেছে বহু তরুণের জীবন। মাদকের নেশায় তরুণ সমাজের অনেকে বুঁদ হয়ে বিপথগামী হয়েছে। মাদকের ভয়াল থাবা প্রতিনিয়ত তৈরি করছে কিশোর অপরাধীদের। আজ দেশে প্রচুর কিশোর গ্যাং তৈরি হয়েছে এবং আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। মাদকের নেশা থেকে কিশোর—তরুণদের বাঁচাতে যখন আমরা হিম শিম খাচ্ছি, ঠিক তখনই স্মার্টফোন নীরবে শিশু—কিশোরদের জন্য আরেক বড় ঘাতক নেশা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাদকের নেশা থেকে মোবাইলের নেশাকে কোন অংশে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আজ প্রতিটি ঘরে প্রতিটি শিশু—কিশোরের হাতে স্মার্টফোন। এক চরম নেশায় বুঁদ হচ্ছে আমাদের শিশু—কিশোররা। অভিভাবকেরা কোনওমতেই যেন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেন না এই ঘাতক নেশাকে। অসহায় হয়ে হয়তো বাচ্চাকে মারধর করছেন। কিন্তু সেটা শিশুর ওপর আরেকটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আবার শিশুর হাতে স্মার্টফোন না দিয়ে তাদের উপায় নেই। কারণ একটি শিশু যখন দেখে তার সব বন্ধুর হাতে স্মার্টফোন, তখন তারও একটা চাই। ভাল—মন্দ বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। কান্নাকাটি করে সে সেটা নেবেই।

শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নে আক্দুল আউয়াল বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জনাব মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, কতটা ভয়াবহ অবস্থা চলছে, তা একটি দৃষ্টান্ত দিয়েই বলি। আমি যেহেতু শিক্ষক, তাই অনেক অভিভাবক আসেন তাদের সন্তানের স্মার্টফোনটি আমার কাছে জমা রাখতে। তাদের এক কথা, ‘স্যার আর পারছি না। কিছু একটা করেন। তাদের অসহায় মুখটি দেখে নিজের কথাও ভাবি। আমারও তো শিশু আছে ঘরে। সেও তো একই নেশায় আচ্ছন্ন। অভিভাবকদেরই কী করার আছে? শিশু—কিশোরদের উম্মুক্ত মাঠে বা প্রান্তরে খেলার সুযোগ অনেক কমে গেছে। শহর অঞ্চলে এ সুযোগ নেই বললেই চলে। তাহলে ঘরে বন্দী শিশুরা কী করবে? কীভাবে কাটবে তাদের সময়? নিরাপত্তার কথা ভেবে শহরে বাবা মায়েরা সন্তানদের বাইরে যেতে দিতে চান না। তাহলে শিশুর মাঝে স্বতঃস্ফূর্ততা আসবে কীভাবে? সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার সংস্পর্শে আসার সুযোগ তাদের কোথায়? একটি বদ্ধ খাঁচায় তারা বেড়ে উঠছে। কীভাবে তবে গড়ে উঠবে তাদের উদার ব্যক্তিত্ব আর মানসিকতা?

আমরা গ্রামে বড় হয়েছি। কোথায় খেলতে চলে গেছি বাবা মা ততোটা খোঁজও রাখতেন না। হয়তো এখনকার মত তখন নিরাপত্তা নিয়ে তাদের ভাবতে হতো না। আজকাল কত শতাংশ শিশু সাঁতার জানে? এ বিষয়ে কোন সঠিক সমীক্ষা নেই। একটু চিন্তা করুন। আমাদের প্রতিদিন প্রায় এক ঘণ্টা সময় কাটত সাঁতার কেটে। চোখ লাল করে বাড়ি ফিরে মায়ের কিছুটা চোখ রাঙানি কতটা মধুর ছিল! বিকেল হলে ফুটবল নিয়ে মাঠে দৌড়। মাঠ না পেলে কোনও কৃষক ধান কেটে জমিটা ফেলে রাখলে সেখানেই খেলা চলত। আজ শিশুদের মাঝে তেমন কোন উদ্যম দেখা যায় না। মোবাইল নিয়েই তারা বিভোর। অনলাইনে গেম খেলা তাদের জীবনের বড় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পাবজিসহ আরো কিছু অনলাইন খেলা আছে, যেগুলো কয়েক জনে মিলে খেলা যায়। অনলাইন খেলায় তারা বিজয় ছিনিয়ে নিতে মরিয়া। অথচ তাদের এ সময়ে মাঠে থাকার কথা ছিল। ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্য কোনও খেলায় তাদের মেতে ওঠার কথা ছিল।

অনলাইনে দীর্ঘ সময় খেলার কারণে তাদের চোখ, স্মৃতিশক্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়। শরীরে পড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব। একটি শিশু মাঠে গিয়ে খেললে তার শরীর গঠন হয়, মানসিক পরিপক্কতা আসে, নেতৃত্বদানের দক্ষতা তৈরি হয় এবং সৌজন্যবোধ শিখে। স্মার্টফোন আজ শিশু—কিশোরদের জীবনী শক্তিকেই যেন চুষে খাচ্ছে। শিশু—কিশোরদের এই স্মার্টফোন নেশা তাদের শিশুত্বকে নষ্ট করে দিচ্ছে। মেধাশক্তিহীন হয়ে পড়ছে এ সকল শিশু—কিশোর। করোনা মহামারিতে স্মার্টফোনের প্রতি শিশু—কিশোরদের নেশা অনেক গুণ বেড়েছে। ঘরবন্দি জীবন আর অনলাইন ক্লাসে থেকে থেকে তাদের আসক্তির মাত্রা বহু গুণে বেড়ে গেছে। একটি বেসরকারি পর্যায়ের জরিপে দেখা গেছে, যে সব বাবা মা চাকরি করেন, তাদের সন্তান মোবাইল আসক্তিতে বেশি ভুগছে। সন্তানকে শান্ত রাখার জন্য বাবা মা হয়তো মোবাইল তাদের সন্তানের হাতে তুলে দেন। কিন্তু তারা একবারও ভাবেন না যে, এই মোবাইলের কারণে কতটা অশান্ত হয়ে উঠছে শিশুদের মন।

এদিকে প্রাই সময় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন মোবাইল শিশুদের বহুবিধ ক্ষতি করে থাকে। এটি শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট করে, তাদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি করে। এক ধরনের বিরূপ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠে শিশুরা। অনলাইন দুনিয়ার মন্দ সাইটগুলোর সংস্পর্শে আসে এসব কোমলমতি শিশুরা। তাদের মন বিগড়ে যায়। বাধাগ্রস্ত হয় তাদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা। এক ধরনের মানসিক বৈকল্য তৈরি হয়। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে সমাজে বড় হয়ে ওঠে, যা বিপজ্জনক।

শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ মফিকুল ইসলাম বলেছেন, স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে শিশুদের মধ্যে নিম্নোক্ত সমস্যার সৃষ্টি হয়। ১. হীনমন্যতা ২. অটিজম ৩. স্বার্থপর মানসিকতা ৪. অমনোযোগ ৫. হতাশা ৬. বিদ্রোহী মনোভাব ৭. কিশোর অপরাধ ৮. জীবনের প্রতি উদাসীনতা ৮. দুশ্চিন্তা ৯. সাইবার বুলিং ১০. আত্মহত্যার প্রবণতা ১১. যৌন হয়রানি ১২. ধর্ষণ। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ৩ জন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ১ জন শিশু। প্রতিদিন প্রায় ২ লাখ শিশু ইন্টারনেট দুনিয়ায় সংযুক্ত হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীর ২৫ শতাংশের বয়স ১০ বছরের কম। ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারীর বয়স ১৭— ২৮ বছরের মধ্যে।

শ্রীপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক এবং শ্রীপুর রিপোটার্স ইউনিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক জনাব মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন,মোবাইলে শিশুদের আসক্তির কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের লেখাপড়া। অধিক রাত পর্যন্ত শিশুরা জেগে থাকে মোবাইল হাতে নিয়ে। কোন বন্ধুর কোনও নতুন মেসেজ এলো কিনা সেটা দেখতে গভীর রাত পর্যন্ত তারা জেগে থাকে। যার ফলে শিশুরা সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। শহরের শিশুরা সকাল ৯ টা পর্যন্ত ঘুমায়। তাদের ঘুম ভাঙাতে বাবা—মাকে গলদঘর্ম হতে হয়। যাহোক পারিবারিক সহিংসতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পেছনে একটি অন্যতম কারণ মোবাইল আসক্তি। এখন প্রশ্ন হলো এর সমাধান কোথায়? বিষয়টি যত সহজে বলা যায়, বাস্তবতা অনেক কঠিন। বাবা—মা যদি সহজে পারতেন, তবে এতদিনে হয়তো সমস্যা সমাধান হয়ে যেত। তাহলে আর কী কী উপায় গ্রহণ করা যেতে পারে? এ ক্ষেত্রে আমি বলব রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন আছে। অনলাইন গেমকে চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে। স্মার্টফোনে যাতে কোনওভাবেই যে পর্নোসাইট কানেক্ট না হয়, সে বিষয়ে রাষ্ট্রকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর পরের ভুমিকা নিতে পারে বিদ্যালয়গুলো। শিশু—কিশোররা প্রায় ৮ ঘন্টা বিদ্যালয়ে থাকে। এ সময়ে তাদের কাছে স্মার্টফোন যেন না থাকে, সেটা বিদ্যালয়কে নিশ্চিত করতে হবে।

পরিবারের সাথে যোগাযোগের দরকার হলে বাটন সেট ব্যবহার করতে পারে। তৃতীয় ধাপে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বাবা—মা। তাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তারা যদি গা ছাড়া ভাব নিয়ে চলেন, তবে শিশুদের মোবাইল নেশা আরও বৃদ্ধি পাবে। যে কোনও কৌশলেই হোক তাদের সেটা করতে হবে। সন্তানকে সময় দিতে হবে। তাদের নিয়ে বেড়াতে যেতে হবে। তাদের মাঠে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে নিজে সাথে যেতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল কাজে বাবা মা তাদের সন্তানকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। আসলে এককভাবে কারো পক্ষে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা। একটি সামাজিক আন্দোলন। আজ যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে কারও যেন সময় নেই। ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। বাবা—মা নিজেরাও মোবাইল নিয়ে বেশেরভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন। এসব প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কিশোর—তরুণদের মাঝে বৃদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ তৈরি করতে হবে। লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের এগিয়ে আসতে হবে শিশুদের অনুপ্রাণিত করতে। শিশুরা সহজে অনুকরণ করে। তাই ওরা যেন ভাল কিছু অনুকরণ করতে পারে সে ব্যবস্থা আমাদের বড়দের করতে হবে। মোবাইলে আসক্তি শিশুদের মাঝ থেকে দেশপ্রেমবোধের স্পৃহাকে কমিয়ে দিচ্ছে, যেটা মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। শিশুদের মাঝে দেশপ্রেম জাগাতে হবে। ছোট থেকেই শিশুরা যেন দুর্নীতিকে ঘৃণা করেতে শেখে, সে ব্যবস্থা বড়দের করতে হবে। শিশুর মন পবিত্র এবং কোমল। এই কোমল মনকে যেভাবে আমরা গড়ে তুলব, সেভাবেই তারা গড়ে উঠবে।

আরো..