মানস আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা
মাদকের আগ্রাসনে তরুণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সুস্থ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে মাদক নির্মূলের বিকল্প নেই। কিশোর-তরুণদেরকে মাদক ও তামাকের নেশা থেকে দুরে রাখতে প্রতিরোধ কর্মসূচি জোরালো করতে হবে। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস-২০২৪ উপলক্ষ্যে ০৯ জুলাই ২০২৪, সকালে বারডেম হাসপাতাল মিলনায়তনে মানস- মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা, এমপি। তিনি বলেন, কোন বাবা-মা চান না তার সন্তান বিপথগামী হোক। পরিবারে একজন মাদকাসক্ত থাকলে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। সমাজ তাদেরকে ভিন্ন চোখে দেখে। একটা সময় ছিলো যখন পথশিশু, ছিন্নমুল মানুষদের মধ্যে মাদকাসক্তি বেশি ছিলো। কিন্তু, বর্তমানে আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে মাদকাসক্তি সমস্যা বাড়ছে। মাদকের নেতিবাচক প্রভাব পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবখানেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এজন্য প্রত্যেক স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়ে মাদক বিরোধী প্রচারণা বাড়াতে হবে, প্রতিরোধে জোর দিতে হবে। দেশে মাদকের চিকিৎসায় উন্নতমানের রিহ্যাব সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এটাও লক্ষণীয় যে, চিকিৎসা নিয়ে অনেকে পূণরায় মাদকে আসক্ত হচ্ছে। তাই নিজেদের পরিবার ও সমাজ থেকে তামাক, মাদক সরিয়ে নিতে পারলে সমস্যা নিরসন সহজতর হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ সকল কাজে সহায়তা করবে।
সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মেস্তাফিজুর রহমান, এনডিসি, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল ইউনিট এর প্রিন্সিপাল অধ্যাপক নাজমা হক, এবং ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস এন্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) এর ন্যাশনাল প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর (ড্রাগস এন্ড এইচআইভি/এইডস) মো: আবু তাহের। মানস এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন ও সভাপতিত্ব করেন এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান তালুকদার। ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন মাহি খন্দকার। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ‘মানস’ এর প্রকল্প সমন্বয়কারী উম্মে জান্নাত এবং সভা আয়োজনে সহায়তা করে ইব্রাহীম মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল ইউনিট।
প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, অনেক ধরনের নেশা আছে। মাদকের নেশা ভয়ঙ্কর। মাদকের ফলাফল কখনোই ভালো হয় না। তামাক ও ধূমপান দিয়ে মাদকাসক্তির শুরু হয়। মাদকাসক্তের মধ্যে ৯৮% ধূমপায়ী। মাদক তিলে তিলে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরাধের পেছনে বড় কারণ মাদক। বাংলাদেশ মাদকে সয়লাভ হয়ে গেছে দেশ। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মাদক দেশে ঢুকছে যা আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি মাদকাসক্ত রয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই কিশোর-তরুণ! এদের ৬০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত, যা অত্যন্ত আতঙ্ক ও ভয়ের কারণ। মাদক নির্মূলে মাদকের সহজলভ্যতা রোধ, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি করা, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ, মাদকাসক্তদের প্রতি বন্ধুত্বসূলভ আচরণ প্রদর্শন ও চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির নিশ্চিত করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দেশে মাদক নির্মূলে কঠোর আইন প্রণীত হয়েছে। মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ তাই ঘৃণা নয়, ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্তদের সারিয়ে তুলতে হবে এবং মাদক গ্রহণ প্রতিরোধ করতে হবে। মাদক নির্মূলে তামাক অর্থাৎ- ধূমপানে নিয়ন্ত্রণে কাজ জোরালো করতে হবে।
খোন্দকার মেস্তাফিজুর রহমান, এনডিসি বলেন, মাদক আসক্তিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও মাদক নিয়ন্ত্রণ যুক্ত রয়েছে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি উল্লেখ করেছেন। বিজিবি, কোস্টগ্রার্ড, পুলিশসহ অনেকগুলো সংস্থার সমন্বয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কাজ করছে। মাদকের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান চলমান থাকবে। কারণ, আমাদের মোট জনসংখ্যার মধ্যে তরুণ-যুবক বেশি, যা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট’ বলা হয়। এই জনগোষ্ঠির জন্য অর্থ ব্যয় করলে আগামী দিনে সুস্থ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। জাতীয় পত্রিকার তথ্য তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, জেলখানায় মাদকের ৪০ ভাগ মাদকাসক্ত। দেশে দৈনিক ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন হয়। মাদক ব্যবসায় ২০০ এর বেশি গডফাদার রয়েছে। এদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। অনুষ্ঠানে মাদক চোরাকারবারীদের ধরতে সহায়তাকারীকে নগদ অর্থ পুরস্কারের ঘোষণা দেন তিনি।
অধ্যাপক নাজমা হক বলেন, সেরা জীব হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। ধূমপান, মাদক দিয়ে আমরা জীবনটা ধ্বংস করে দিচ্ছি। সব দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর অর্পণ করে দিয়ে বসে থাকলে হবে না বরং নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে। চলচ্চিত্রে নায়কদের ধূমপান দেখে মানুষ উৎসাহিত হয়। এ ধরনের মাদক, তামাকের হাতছানি বন্ধ করতে হবে। তরুণরাই সমাজের সম্ভাবনাময় ও যোগ্য প্রতিনিধি। একজন মা হিসেবে তরুণদেরকে মাদকমুক্ত থাকার আহ্বান জানাতে চাই।
মো: আবু তাহের বলেন, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলেই মানুষ মাদকে উৎসাহিত হয়। এখন নারীদের মধ্যেও মাদক ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে ঢাকা, নারায়নগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় মাদকাসক্তদের মধ্যে এইচআইভি এইডস্ রোগ বাড়ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক! অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের একটা বড় মাধ্যম মাদক বেচাকেনা। অর্থের প্রলোভনে রাজনৈতিক ছত্রছায়া, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রভাবশালীদের দ্বারা মাদকের বিস্তার ঘটছে। মাদকদ্রব্যের আগ্রাসন প্রতিরোধে সচেতনতা ও চিকিসায় সেবা সহজলভ্য ও মান বাড়ানো এবং এসব খাতে অর্থ বরাদ্দের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সভায় সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ, ইব্রাহীম মেডিকেল কলেজ এর শিক্ষকবৃন্দ ও শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন।