আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভারতে সংখ্যালঘু, সাংবাদিক এবং নাগরিক সমাজের পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ২০২৩ সালে প্রকাশিত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক প্রতিবেদনটির উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবস্থা নিয়ে প্রবল উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। ভারত সেই প্রতিবেদনকে ‘ভ্রান্ত তথ্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছিল। তবে ওয়াশিংটনের মানবাধিকারবিষয়ক সর্বশেষ এই প্রতিবেদন নিয়ে এখনো মুখ খোলেনি নয়াদিল্লি।
বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে গত এক বছরে অন্তত ছয়টি বড় ধরনের ঘটনার কথা উল্লেখ হয়েছে, যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরনের হামলা হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে রয়েছে হরিয়ানায় মোহাম্মদ জুনায়েদ ও মোহাম্মদ নাসির নামে দুই ব্যক্তিকে গরুচোর হিসেবে চিহ্নিত করে হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতকারীরা গাড়ির মধ্যে তাঁদের আটকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা, মহারাষ্ট্রের আকোলায় ১৩ মে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে এক ব্যক্তির মৃত্যু এবং অন্তত আটজনের আহত হওয়ার ঘটনা।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ঘটনা ঘটেছিল নবীর নামে সামাজিক মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার কারণে। অন্য দেশ থেকে আসা শ্রমিকদের ওপর হামলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ ছাড়া আরও একাধিক ঘটনার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সাংবাদিক, নাগরিক সমাজ, শিখ ধর্মীয় সমাজ, (বিজেপির) রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছেন। তারা এই ব্যক্তিদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে চিহ্নিত করেছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের পরিস্থিতির বর্ণনার মধ্য দিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদন শুরু করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে গত বছর কুকি ও মেইতেই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত সংঘাতের ফলে উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ৩ মে থেকে ১৫ নভেম্বরের (২০২৩) মধ্যে অন্তত ১৭৫ জন নিহত হয়েছেন এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকেরা বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয় ধ্বংসের পাশাপাশি সশস্ত্র সংঘর্ষ, ধর্ষণ ও হামলার প্রতিবেদন করেছেন। সহিংসতার প্রতিক্রিয়ায় সরকার নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন, কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।
মার্কিন প্রতিবেদনে ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের একেবারে গোড়ার দিকে একটু দীর্ঘতম তালিকা দিয়ে বলা হয়েছে, কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেদনের গোড়াতেই একটি বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, কোন কোন ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং তার সূত্র কতটা গভীরে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতেরই কিছু বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন। এর মধ্যে রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ নির্বিচার বা বেআইনি হত্যা, বলপূর্বক গুম, সরকারি বাহিনীর নির্যাতন বা নিষ্ঠুর ও অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তি, কারাগারের এমন অবস্থা, যেখানে জীবনের আশঙ্কা রয়েছে; নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা আটক, রাজনৈতিক বন্দী বা বন্দীদের নির্বিচার আটক ইত্যাদি।
কোনো আত্মীয়ের অপরাধের জন্য পরিবারের সদস্যদের শাস্তি, কথিত বেআইনি বা ব্যাপক বেসামরিক মৃত্যু, শারীরিক নির্যাতন এবং সংঘাত-সম্পর্কিত যৌন সহিংসতা বা শাস্তিসহ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি, সাংবাদিকদের অযৌক্তিক গ্রেপ্তার বা বিচার, মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি রয়েছে। এ ছাড়া ফৌজদারি মানহানি আইনের মামলা থেকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর বিধিনিষেধ, ইন্টারনেটের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর নিষেধাজ্ঞা প্রভৃতি রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ওপর গুরুতর সরকারি বিধিনিষেধ বা হয়রানি, ব্যাপক লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যার মধ্যে গার্হস্থ্য বা অন্তরঙ্গ সঙ্গীর সহিংসতা, যৌন সহিংসতা, কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা, শিশু, বাল্য ও জোরপূর্বক বিবাহ, নারীদের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা থেকে জাতিগত ও বর্ণগত সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে সহিংসতার হুমকির পাশাপাশি সমকামী, ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর তথ্যচিত্র সম্প্রচারের পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসিকে ভারতের আয়কর বিভাগ হেনস্তা করেছে। এ কথা জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে ২০২৩ সালে ১৮০ দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ১৬১ নম্বরে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগে কখনো ভারতের অবস্থা এত খারাপ ছিল না।