https://www.a1news24.com
৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৮:১০

বিএনপি নেতার ‘এফ.ভি হক’ জাহাজ নিয়ে কর্ণফুলী ওসির লঙ্কাকাণ্ড!

নিজস্ব প্রতিবেদক : কক্সবাজার-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাসিনা আহমেদ প্রকাশ হাসিনা হকের মালিকানাধীন এফ.ভি হক ফিশিং জাহাজটি সাগর থেকে কর্ণফুলী নদীতে ফিরলে নৌ পুলিশ ও কর্ণফুলী পুলিশের মধ্যে এক তুলকালাম কাণ্ড ঘটে। জাহাজটির মালিক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদ এর সহধর্মিণী বলে জানা যায়।

গত রোববার রাত ১০টা থেকে শুরু হয়ে প্রায় ৪ ঘন্টাব্যাপী কর্ণফুলী থানার ওসির অফিস রুমে জাহাজের দুই পক্ষকে বসিয়ে নিজেই এক লঙ্কাকাণ্ড ঘটান ওসি মোহাম্মদ মনির হোসেন। এমন অভিযোগ সাবেক এমপির প্রতিষ্ঠান আকোয়া কালচার (প্রাঃ) লিমিটেড এর কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার মো. ফোরকান (৩২) এর।

তথ্য পাওয়া গেছে, গত ২৬ সেপ্টেম্বর জাহাজটির বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে হক আকোয়া কালচার (প্রাঃ) লিঃ এর এক কর্মকর্তা কর্ণফুলী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। যার জিডি নম্বর-১৩০৩।

জিডিতে তিনি উল্লেখ্য করেন, এফ.ভি হক ফিশিং জাহাজটির প্রকৃত মালিক বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ এর স্ত্রী মিসেস হাসিনা হক। তিনি বিশেষ কারণে দেশের বাইরে থাকাকালে নগরীর চকবাজার নাসিরাবাদ হাউজিং এলাকার জনৈক নাজমে নওরোজ নামীয় এক নারীকে জাহাজটি পরিচালনার দায়িত্ব দেন।

কিন্তু হক আকোয়া কালচার (প্রাঃ) লিমিটেড এর কর্মকর্তাদের দাবি দীর্ঘ ৯ বছরের অধিক সময় ধরে কোন হিসাব বা খোঁজ খবর ছিলো না জাহাজটির। পরে জানতে পারেন জাহাজটি সী পাওয়ার নামক একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। জাহাজটি বর্তমানে কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড় বিএফডিসি এর জেটির বেসিনে রয়েছে।

এতে জাহাজটি নিয়ন্ত্রণে নিতে গেলে অজ্ঞাত বিবাদীরা ভয়ভীতিসহ প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করে এবং অজ্ঞাত লোকজন জাহাজে অবস্থান নেয় বলে জিডিতে উল্লেখ করেন।

এমন পরিস্থিতি হক আকোয়া কালচার (প্রাঃ) লিঃ এর কর্মকর্তারা ন্যায়সঙ্গত ভাবে তাঁদের জাহাজটি প্রতিষ্ঠানের নিজ হেফাজতে পেতে সহযোগিতা পেতে কর্ণফুলী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ডকে অবগত করেন।

এ সময় থানা জিডিটি লিপিবদ্ধ করেন কর্ণফুলী থানার ডিউটি অফিসার মির্জা মনিরুজ্জামান। একই সময়ে কর্ণফুলী থানার ওসি মোহাম্মদ মনির হোসেন এই ডায়েরি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে ওসি তদন্ত মেহেদী হাসানকে দায়িত্ব দেন।

নথিপত্র বলছে, একই বিষয়ে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তরের পরিচালকের কাছে এফ.ভি হক ফিশিং জাহাজের মৎস্য আহরণে সমুদ্রে গমনে (এসপি) বন্ধ রাখার আবেদন করেন হক আকোয়া কালচার (প্রাঃ) লিঃ। এমন কি বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপকের কাছেও লিখিত অভিযোগ দেন।

এতে জাহাজ মালিক হিসেবে জাহাজের ই-ট্রেড লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ট্রলারের ফিশিং লাইসেন্স এর অনুমতিপত্র, ট্রলারের স্পেসিফিকেশন অনুমোদন পত্র, ইন-কর্পোরেশন সার্টিফিকেট সংযুক্ত করেন হক আকোয়া কালচার (প্রাঃ) লিমিটেড।

পরবর্তী ঘটনা সূত্রে জানা যায়, গত রোববার রাতে এফভি হক নামক ফিশিং জাহাজটি সাগর থেকে ফিরে কর্ণফুলী নদীর বিএফডিসি জেটিতে অবস্থান করেছে বলে খবর পান হক আকোয়া কালচার (প্রাঃ) লিমিটেড।

তাৎক্ষণিক তাঁরা বিষয়টি মুঠোফোনে জিডি তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর মেহেদী হাসানকে জানান। তদন্ত কর্মকর্তা কর্ণফুলী থানার ওসির সাথে কথা বলে জানাচ্ছেন বলে ফোন বিছিন্ন করেন হক আকোয়া কালচারের।

কিছুক্ষণ পরে ওসি তদন্ত ফোন করে জানান, ওসি স্যার পূজা মণ্ডপে আছেন ১০ মিনিট পরে জানাবেন। তার কিছু সময় পর হক আকোয়া কালচারের কর্মকর্তারা যোগাযোগ করলে ওসি তদন্ত জানান, ‘এ বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ আছে বলে ওসি জানান। তাঁকে না যেতে নিষেধ করেছেন।’

পরে পূর্বে থেকে একই বিষয়ে অবগত করে রাখা নৌ পুলিশের শরণাপন্ন হন ভুক্তভোগী হক আকোয়া কালচারের কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার মো. ফোরকান।
নৌ পুলিশের উপস্থিতিতে স্থানীয় গন্যমান্য লোকজনকে সাথে নিয়ে তাঁরা জাহাজে গিয়ে লোকজনের সাথে বলেন।

এমনকি জাহাজে থাকা লোকজনকে জানান, এই জাহাজের প্রকৃত মালিক মিসেস হাসিনা হক। এর বিপক্ষে তাঁদের কোন কাগজপত্র আছে কিনা। কিন্তু জাহাজে লোকজন কোন ধরণের কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। বরং হাইকোর্ট বিভাগের অ্যাডমিরালটি জুরিডেকশন এর একটি আদেশ দেখান। যা যাচাই-বাছাই করার বিষয়।

এসব কথাবার্তা চলাকালে জাহাজে উঠে আসে কর্ণফুলী থানার এসআই মনিরুজ্জামান ও সঙ্গীয় ফোর্স। তাঁরা উঠেই নৌ পুলিশকে জানান, ‘এ বিষয়ে কর্ণফুলী থানায় আগেই জিডি আছে। তাঁরা বিষয়টি দেখবেন। আর জাহাজের দুই পক্ষকে জানান কর্ণফুলী ওসি দুই পক্ষকে থানা যেতে বলেছেন। যার যার কাগজ নিয়ে।’

ঘটনার দিন রাত ১২ টার সময় দুই পক্ষের লোকজন কর্ণফুলী থানায় যান। সেখানে চরপাথরঘাটার সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যসহ হক আকোয়া কালচারের কর্মকর্তা এবং সী পাওয়ার কোম্পানির লোকজনের উপস্থিতিতে অনেক তর্ক বিতর্ক ও আলোচনা হয় ঘন্টার পর ঘন্টা।

চার ঘন্টাব্যাপী আলোচনা করেও কোন সিদ্ধান্ত যেতে পারেনি। সী পাওয়ার প্রতিষ্ঠান মালিক প্রমাণে জাহাজের কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি বলে সুত্রের দাবি। এক পর্যায়ের তারা আদালতের আদেশের মূলকপি চাইলেও তা দেখাতে ব্যর্থ হন।
একই সময়ে বিএনপি নেতা সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদও কয়েকবার হোয়াটসএ্যাপে ওসির সাথে কথা বলেন বলে সুত্র নিশ্চিত করেন।

এত কাণ্ড কারখানার পরও কর্ণফুলী থানার ওসি মোহাম্মদ মনির হোসেন বেঁকে বসেন। জাহাজ জব্দ করা হলেও জাহাজে থাকা মাছ বিক্রি করতে পারবে বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু হক আকোয়া কালচার কর্মকর্তাদের দাবি সব কিছু জিডি মূলে তৃতীয় পক্ষের কাছে জমা থাকবে। আদালতের নির্দেশ মতে পরবর্তী কার্যক্রম হবে। কিন্তু ওসি এটি কিছুতেই মানতে নারাজ বলে হক আকোয়া কালচার প্রাইভেট লিমিটেডের দাবি।

বিপরীতে প্রথম জিডি তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে যেতে চাইলেও যেতে না দেওয়া ও পরে অন্য এসআই কে ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে থানায় নিয়ে আসার আগেই ওসির রুমে বিবাদীপক্ষ বসা ছিলেন বলেও দাবি করেন হক আকোয়া কর্মকর্তাদের দাবি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী থানার ওসি তদন্ত মেহেদী হাসান বলেন, ‘আসলে আমার কাছে জিডি থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমি কোন ধরণের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ পাইনি। ওসি স্যার নিজেই উনার রুমে দুই পক্ষকে ডেকে রাতে কি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আমি জানি না। আপনারা ওসি স্যারের সাথে কথা বলুন।’

কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত দিইনি। জাহাজটি জব্দও নেই। এটি নৌ পুলিশ দেখবেন। আমাদের কাছে মালিক দাবি করে একটি পক্ষ জিডি করেছেন তা আমরা তদন্ত করব। অপরপক্ষ, হাইকোর্টের একটি আদেশও এনেছেন। আমরা দুই পক্ষকে বলছি উচ্চ আদালতে যেতে।’

ঘটনার দিন রাতে বৈঠকে থাকা বিএনপি নেতা সুত্র জানায়, ‘রাতে ওসির রুমে আলোচনা হলেও আদালতের আদেশ মতে জাহাজ জব্দ থাকলেও মাছ পার্টি মাছ নামাবেন বলে ওসি মন্তব্য করেছিলেন। যা ছিলো অযৌক্তিক। এখন শুনতেছি ওসির কথা পাল্টে গেছে। নদীর ঘটনা নৌ পুলিশের বিষয় ছিলো কিন্তু কর্ণফুলী থানা পুলিশ জিডির অজুহাতে দুই পক্ষকে ডেকে নিলেও এখন হয়তো সুর পাল্টাচ্ছেন।’

এ প্রসঙ্গে সদরঘাট নৌ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. একরামুল হক বলেন, ‘এ ধরনের একটি খবর পেয়ে রাতে তাৎক্ষণিক আমি নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ টিম পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু পরে জানতে পারি ওখানে কর্ণফুলী থানা পুলিশ এসে পুর্বের জিডির কথা বলে দুই পক্ষকে ওসি স্যারের কাছে নিয়ে গেছেন। পরে নৌ পুলিশ চলে আসেন।’

আরো..