https://www.a1news24.com
১৪ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ভোর ৫:২৭

প্রযুক্তি জগতে কর্মী ছাঁটাই কি অব্যাহত থাকবে?

প্রযুক্তি ও গবেষণা ডেস্ক- মেশিন লার্নিং ও অটোমেশনের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির উৎকর্ষ্যে সাধারণ মানুষের চাকরি হারানোর বিষয়টি নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর, সমাধানের সম্ভাব্য পথ খোঁজার চেষ্টাও হয়েছে নানাভাবে। কিন্তু সমাধান তো আসেইনি বরং খোদ প্রযুক্তি খাতেই নিয়মিত কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরে। চলতি বছরেই এখন পর্যন্ত লাখেরও বেশি প্রযুক্তি কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।

সম্প্রতি লেঅফস ডট এফওয়াইআই (layoffs.fyi) সাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বিশ্বের ৪৯৩টি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত ১,৪৩,২০৯ জন কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। একই সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে ১,১৯৩টি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে ২ লাখ ৬৪ হাজার ২২০ জন কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। তার আগের বছর (২০২২ সালে) প্রযুক্তি জগতের ১,০৬৪টি প্রতিষ্ঠানে চাকরিচ্যুত কর্মীর সংখ্যাটা ছিল ১,৬৫,২৬৯।

করোনা মহামারির সময় বিশ্ব অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যখন একের পর এক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে, লাখো কর্মী চাকরি হারিয়েছে, তখনও প্রযুক্তি খাতে এত মানুষ চাকরি হারায়নি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর কারণও অবশ্য ছিল। করোনার সময় মহামারি ছড়িয়ে পড়া রোধে দেশে দেশে লকডাউনের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সংকুচিত হয়ে আসে বাইরের জীবন। ফলে ঘরবন্দী মানুষের একটা বড় অংশ প্রযুক্তিমুখী হয়ে ওঠে। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গেমিং, ওটিটি, ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্মের মতো খাতগুলোর ব্যাপক প্রসার ঘটে। হোম অফিসের কল্যাণে প্রয়োজনীয় প্রাযুক্তিক অফিস টুলেরও প্রসার হয়। প্রযুক্তি খাতের এই সম্প্রসারণের সময় প্রচুর নিয়োগও হয়।

করোনার পর মানুষের বাইরের পৃথিবী আবার উন্মুক্ত হয়। প্রযুক্তি পণ্যের ভোগ যায় কমে। ফলে বিশেষত ফেসবুক, এক্স‑এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের বর্ধিত কর্মীবাহিনী ছোট করে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয় ছাঁটাই। এই একই সময়ে জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তির উন্মোচন ও প্রসার ঘটে।

ফলে বিগত কয়েক বছরে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অটোমেশন প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়েছে। অনেক ক্ষত্রে এআই প্রযুক্তি মানুষের সক্ষমতা এতটাই বৃদ্ধি করেছে যে, কর্মী ছাঁটাই করেও আগের চেয়ে বেশি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।

ছোট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হেঁটেছে টেসলা, অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফট, টিকটকের মতো শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোও। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত পরিবর্তন, যেখানে এআই প্রযুক্তির প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে আয়ের প্রবাহ আশানুরূপ না হওয়ায় হয়তো কোনো একটি বিভাগ বা পুরো প্রতিষ্ঠানই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ফলে চাকরি হারিয়েছেন কর্মীরা।

অতি সম্প্রতি মোজিলা, এক্স এবং স্যামসাং নতুন করে কর্মী ছাঁটাই করেছে। জনপ্রিয় ওপেনসোর্স ইন্টারনেট ব্রাউজার ফায়ারফক্স-এর নির্মাতা মোজিলা ফাউন্ডেশন সম্প্রতি ৩০ শতাংশ কর্মীকে ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। মোজিলা জানিয়েছে, ‘ক্রমাগত পরিবর্তনের আধিক্য’ তাদেরকে কর্মী ছাঁটাই করতে এক রকম বাধ্য করেছে।

মোজিলা ফাউন্ডেশনের যোগাযোগ বিভাগের প্রধান নির্বাহী ব্র্যান্ডন বরম্যান কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান বর্তমানে পূনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তির এমন এক ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা, যেটা হবে আরও উন্মুক্ত এবং যেখানে সকলের সমান সুযোগ থাকবে।

প্রযুক্তি জগতে কর্মী ছাঁটাই কি অব্যাহত থাকবে?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই একটি ডিসরাপটিভ প্রযুক্তি। এখনও এই প্রযুক্তির শতভাগ সম্ভাবনার সামান্যই আমরা বাস্তবে পরিণত হতে দেখেছি। এমনকি এআই প্রযুক্তির সম্ভাবনার পুরোটা হয়তো আমরা কল্পনা করেও উঠতে পারিনি। সেদিক থেকে প্রচলিত প্রযুক্তির চলমান ধারায় আসছে দিনগুলোতে এআই আরও বড় আকারের বিঘ্ন ঘটাবে এমনটা বেশ অনুমান করা যাচ্ছে।

বাস্তবিক অর্থেই এআই বলতে আজকে আমরা যা দেখছি, বিশেষ করে চ্যাটজিপিটি-পরবর্তী সময়ে, সেটা জেনারেটিভ এআই- যা মেশিন লার্নিং‑এর একটি অংশ মাত্র। তবে এআই প্রযুক্তির উন্নয়ন বেশ দ্রুত গতিতেই হচ্ছে। বিশেষ করে এনভিডিয়ার মতো প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত উঁচু মানের, শক্তিশালী এআই চিপ তৈরি করছে, ফলে দিন যত যাচ্ছে এআই সার্ভার ও ডেটা সেন্টারগুলোর সক্ষমতাও তত বাড়ছে। আর তাই এআই নিয়ে গবেষণা কার্যক্রমও ত্বরান্বিত হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে অদূর ভবিষ্যতে এআই প্রযুক্তি যে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসতে চলেছে, সেটা ভালোভাবেই ধারণা করা যাচ্ছে। বিশেষ করে অটোনোমাস বা স্ব-নিয়ন্ত্রিত এআই প্রযুক্তির একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু উদাহরণই এখন পর্যন্ত আমরা দেখতে পেয়েছি। সম্প্রতি যেমন দেখা গেল টেসলা’র চালকবিহীন বৈদ্যুতিক গাড়ি ‘সাইবারক্যাব’ রোবোট্যাক্সি, রোবোভ্যান ও মানবাকৃতির (হিউম্যানয়েড) রোবোট ‘অপটিমাস’।

এদিকে ইভিটল (ইলেকট্রিক ভার্টিক্যাল টেক-অফ অ্যান্ড ল্যান্ডিং) প্রযুক্তির আকাশযানেরও (‘ফ্লাইং কার’ সদৃশ) উন্নয়ন হচ্ছে বেশ দ্রুত গতিতে। আগামী ১-২ বছরের মধ্যে ইভিটল‑ভিত্তিক ট্যাক্সি সার্ভিস বাণিজ্যিকভাবে শুরু হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রশ্নে না গিয়েই বলা যায় যে, অটোনোমাস এআই প্রযুক্তির পরিপূর্ণ বিকশিত রূপ কেমন হবে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব কতটা গভীর হবে, এই মুহূর্তে সেটা হলফ করে বলা বেশ কঠিনই বটে। তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, আসছে দিনগুলোতে এআই প্রযুক্তির ক্রমশ বিকাশমান রূপ আমরা নতুন নতুন ক্ষেত্রে দেখতে পাব এবং দিন যত গড়াবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এআই প্রযুক্তির প্রভাবও তত বাড়বে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা কমে আসবে এমনটা বলা যাচ্ছে না। তবে এটাও ঠিক, এআই প্রযুক্তির যত বেশি বিকাশ হবে, এআই-কে ঘিরে নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্রও তৈরি হবে। এক্ষেত্রে কর্মীদেরকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে জানতে হবে এবং এই প্রযুক্তিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।

তথ্যসূত্র: লেঅফস ডট এফওয়াইআই (layoffs.fyi), টেকক্রাঞ্চ, ইন্ডিয়া টুডে

আরো..