অনলাইন ডেস্ক: রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে ১৫ বছর পর মুখ খুললেন সেই সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। ওই ঘটনার সঠিক তদন্ত করে করে প্রকৃত দোষীদের বিচারের দাবিও জানিয়েছেন তিনি।
আলোচিত ‘ওয়ান-ইলেভেন’র অন্যতম চরিত্র মঈন ইউ আহমেদ গত বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) তার নিজের ইউটিউব চ্যানেলে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে তার ভাষ্য তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঢাকার পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহ। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা এবং ১৭ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। দীর্ঘ ১৫ বছরে ওই ঘটনার ‘আসল রহস্য’ উন্মোচিত হয়নি দাবি করে এরই মধ্যে অনেকেই হত্যাকাণ্ডের পুনঃতদন্তও দাবি করেছেন।
বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যাকাণ্ড অনেক আলোচনা হয়। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থানরত সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে এই প্রথম মুখ খুললেন।
আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালে কথাগুলো বলতে চেয়েও পারেননি বলে জানান মঈন। তবে তিনি মনে করেন, তখন সেনাবাহিনী কী ভূমিকা নিয়েছিল এবং ঘটনা কী ছিল, সে সম্পর্কে মানুষের জানা উচিত। বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি এখন ঘটনাগুলো তুলে ধরতে পারছেন।
মঈন ইউ আহমেদ বলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহ ঘটনায় আমি যখন তদন্তের আদেশ দেই, তখন আমাকে বলা হয়, যখন সরকার এই বিষয়ে তদন্ত করছে, তখন আমাদের এর প্রয়োজনটা কী? এই তদন্ত করতে সরকারের কাছ থেকে যে সাহায্য প্রয়োজন, তা আমরা পাইনি।’
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ‘সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেফটন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা)। তিনি তার কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেননি, কারণ অনেকে জেলে ছিল, অনেককে প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি। আমার কাছে এসে তিনি (জাহাঙ্গীর আলম) বেশ কয়েকবার তার সমস্যার কথা তুলে ধরেন।’
অন্তর্বতীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এখন ওই ঘটনার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন, এমন আশা প্রকাশ করেন মঈন ইউ আহমেদ বলেন, ‘তিনি (জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী) এই তদন্ত কমিটি পুনর্গঠিত করে জড়িতদের বের করতে সক্ষম হবেন। আমি সরকার গঠনের পর তাকে এই বিষয়ে অনুরোধ করেছি।’
বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে তার লেখা বই খুব শিগগির প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।বিদ্রোহের সময় টিভি চ্যানেলে লাইভ কাভারেজের সমালোচনা করে তৎকালীন সেনাপ্রধান বলেন, ‘ঘটনার সময়ে গণমাধ্যমে চলা লাইভ কাভারেজ বিডিআর বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিতে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।’
সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে মঈন ইউ আহমেদ বলেন, সেদিন (২০০৯ সালের) ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে সাড়ে ৭টায় সেনা সদরের প্রতিদিনের মতো কাজ শুরু হয়। সকালে আমি সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় সিজিএস লেফটেনেন্ট জেলারেল সিনহা আমার কাছে এসে বলেন, আমাদের কাছে কিছু এইটি-ওয়ান মিলিমিটার মর্টার আছে, যা সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না। এর গুদামজাত এবং রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের জন্য কঠিন। বিডিআর এগুলো ব্যবহার করে। এগুলো তারা নিয়ে গেলে আমাদের উপকার হবে।
তিনি আরও বলেন, এরপর আমি বিডিআরের ডিজির জেনারেল শাকিলের সঙ্গে কথা বললে তিনি এগুলো নিতে সানন্দে রাজি হন। আমার বিশ্বাস তিনি তখন পর্যন্ত এই বিদ্রোহ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এরপর আমি এবং সিজিএস মিটিংয়ের জন্য যাই। ৯টায় সেই মিটিং শুরু হয়। আমরা সবাই তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ি সেখানে। সাড়ে ৯টায় তার দিকে আমার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ রুমে প্রবেশ করে আমাকে কানেকানে বলেন, পিলখানায় গণ্ডগোল হচ্ছে। আপনার দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। সভা স্থগিত করে সিজিএস এবং ডিরেক্টর মিলিটারি অপারেশনকে সঙ্গে নিয়ে আমার অফিসে আসি। কিছুক্ষণ পর আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের ফোন ব্যস্ত পাই।
মঈন ইউ আহমেদ বলেন, সামরিক গোয়েন্দারা তখন আমাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আমি তখন সময় বাঁচাতে কারও নির্দেশ ছাড়া আরেকটি ব্রিগেডকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেই। তারা তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে, যার নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন রেস্টোর অর্ডার’।
সাবেক এই সেনাপ্রধান আরও বলেন, ৯টা ৪৭ মিনিটে ডিজি বিডিআরকে ফোনে পাওয়া যায়। তিনি আমাকে জানান, দরবার চলাকালীন দুজন সশস্ত্র সৈনিক প্রবেশ করে। একজন আমার পেছনে দাঁড়ায়। এর পরপরই বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসে। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে থাকা সৈনিকরা দরবার হল থেকে বের হয়ে যায়। এগুলো সবই মনে হয় প্ল্যান করা এবং প্ল্যান অনুযায়ী সব চলছে। তিনি বলেন, আমি সেক্টর কমান্ডার এবং ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদেরকে পাঠিয়েছি তাদের ফেরত আনার জন্য, যাতে পুনরায় দরবার শুরু করা যায়। তখন আমি তাকে অপারেশনের কথা জানাই।
মঈন ইউ আহমেদ বলেন, অনেকে মনে করে ডিজি বিডিআর আমাকে ফোন করেছেন, তথ্যটি সঠিক নয়। আমিই তাকে ফোন করে আমরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছি তা তাকে জানিয়ে দেই।
সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, ৯টা ৫৪ মিনিটে আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ফোনে পেয়ে যাই। এর মধ্যেই তিনি বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গিয়েছেন। এ সময় আমি তাকে অপারেশনের কথা জানালে তিনি জানতে চান, কতক্ষণ সময় লাগবে এই ব্রিগেড তৈরি করতে? আমি সময় জানিয়ে ব্রিগেডকে পিলাখানায় যাওয়ার জন্য তার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দেন। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় লাগলেও ৪৬ ব্রিগেড ১ ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা শুরু করে।
সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, এদিকে বিদ্রোহীরা বিডিআর গেটগুলোর সামনে আক্রমণ প্রতিহত করতে রকেট লাঞ্চার, মর্টারসহ অন্যান্য অস্ত্র মোতায়েন করে। বেলা ১১টায় ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম গাড়িটি মেইন গেটের কাছাকাছি পৌঁছলে বিদ্রোহীরা একটি পিকআপ লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালায়। এতে চালক ঘটনাস্থলেই মারা যান। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের ধারণা অনুযায়ী সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যেই ডিজি, ডিডিজি, কর্নেল আনিস, কর্নেল কায়সারসহ অনেক অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমাদের টিম পৌঁছায় ১১টার পর।
মঈন ইউ আহমেদ জানান, ক্যাপ্টেন শফিক তার নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র্যাব সদস্য নিয়ে পিলখানায় পৌঁছান ১০টার আগেই। এ সময় তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পিলখানায় প্রবেশের অনুমতি চাইলেও তিনি তা পাননি। তিনি অনুমতি পেলে হয়তো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সুবিধা হতো এবং এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।
সাবেক এই সেনাপ্রধান বলেন, ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে পিএসও এএফডি জানায়, সরকার রাজনৈতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, কোনো আলোচনার আগে সেনাবাহিনীকে এই এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। তাদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে তখন সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হবে। বেলা ১২টায় তিনি আমাকে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যমুনায় দেখা করতে বলেন। বেলা ১টার দিকে জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজম আলোচনার জন্য পিলখানায় যান। আমি যমুনায় যাওয়ারও ঘণ্টাখানেক পর বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধান সেখানে আসেন। অর্থাৎ তাদেরকে আমার পরে ফোন করে আসতে বলা হয়েছে। অনেকক্ষণ পর তারা সেখানে এলে আমাদের জানানো হয়, সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং হুইপ মির্জা আজম বিদ্রোহীদের একটি দল নিয়ে যমুনায় আসছে এবং তারা সাধারণ ক্ষমা চায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্রোহীদের কিছু বলার থাকলে আমরা যেন তাদের বলি। তখন আমি তাকে বলি, অনেকে নিহত হয়েছেন। তাদের কোনো দাবি মানা যাবে না। আপনি তাদের বলবেন প্রথমত, অফিসার হত্যা এ মুহূর্তে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের সবাইকে এখনই মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, অস্ত্রসহ বিদ্রোহীদের আত্মসমপর্ণ করতে হবে এবং চতুর্থত, সাধারণ ক্ষমা দেয়ার প্রশ্নই নেই।
ভিডিওতে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন মঈন ইউ আহমেদ। এ সময় বিডিয়ার বিদ্রোহ নিয়ে তার লেখা বই খুব শিগগিরই প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।