https://www.a1news24.com
৯ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ১২:৫২

পার্বত্য চট্টগ্রামে সঙ্ঘটিত হামলা ও হত্যার প্রতিবাদে অস্ট্রেলিয়ায় বিক্ষোভ

গত ১৮ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর এবং ১ অক্টোবর ২০২৪ বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দিঘীনালা উপজেলা ও রাঙ্গামাটি জেলা সদরে পাহাড়ি আদিবাসীদের উপর ধারাবাহিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। ১৯ তারিখ খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর গুলিতে দুজন আদিবাসী তরুন খুন হন। সেটলারদের পরিকল্পিত আক্রমণে ১৯ তারিখ দিঘীনালায় একজন আদিবাসী ব্যক্তি ও ২০ তারিখ রাঙ্গামাটিতে একজন আদিবাসী তরুন খুন হন। [i][ii] [iii][iv]

সেটলারদের পরিকল্পিত হামলায় শতাধিক ব্যক্তি হতাহত হয়েছেন। অনেকে অঙ্গহানি সহ গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। পাহাড়িদের বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বৌদ্ধ মন্দিরে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী পাহাড়িরা আতংকের মধ্যে দিনযাপন করছেন কেননা প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে এসব হামলার ঘটনা ঘটছে। খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা চলাকালীন সময়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই সেটলাররা সংগঠিতভাবে হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। সেনানিবাস ও পুলিশ ব্যাটালিয়ন থেকে আক্রান্ত আদিবাসীদের গ্রাম ৫-১০ মিনিটে পৌঁছানোর দূরত্বে থাকা সত্বেও তারা হামলা চলাকালে রহস্যময় কারণে কোনো পদক্ষেপ না তারা আক্রমণে উস্কানি দিয়েছে। ইতোপূর্বেও আদিবাসী জনপদে এ ধরনের আক্রমণ ঘটেছে এবং কখনোই প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয় না।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক আক্রমণ ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিদ্যমান। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসনের মাধ্যমে আদিবাসীদের উপর পদ্ধতিগত গণহত্যা বা “স্ট্রাকচারাল জেনোসাইড” এবং “এথনিক ক্লিনজিং” বা জাতিগত নিধন সঙ্ঘটিত হচ্ছে  বলে দেশ-বিদেশের মানবাধিকার কর্মী, স্কলার, ও পাহাড়ি জুম্ম আদিবাসীরা দাবী করে আসছেন।[v][vi][vii]

এই চলমান আদিবাসী নিপীড়ন বন্ধ করতে হলে সামরিক শাসন বন্ধ করা, সংবিধান সংশোধন, শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন সহ রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। পাহাড়ি আদিবাসীদের উপর চলমান নিপীড়ন ও জাতিগত নিধনের চক্রান্তের প্রতিবাদে ও আদিবাসীদের ভূমি-জান-মাল-আত্মপরিচয়ের  অধিকারের দাবিতে অস্ট্রেলিয়াজুড়ে চলছে বিক্ষোভ সমাবেশ অবস্থান কর্মসূচি।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল দশটায় নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের রাজধানী সিডনী ও সাউথ অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী এডিলেইডে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। চিটাগাং হিল ট্র্যাক্সটস ইন্ডিজেনাস জুম্ম এসোসিয়েশন অফ অস্ট্রেলিয়া ও সিডনী জুম্ম কমিউনিটির উদ্যোগে সিডনী টাউন হলের সামনে আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন নেপালিস ইন্ডিজনাস ফেডারেশন, গারো সোসাইটি অফ অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেশন ফর এথনিক এন্ড রেলিজিয়াস মাইনরিটিজ ইন বাংলাদেশ, রাখাইন কমিউনিটি অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিবৃন্দ।

যুগপৎ বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসাবে অভিন্ন দাবিনামা নিয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে এডিলেইডের সাউথ অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট হাউজের সামনে। সভায় অংশগ্রহণকারীরা কালো মাস্ক পরে আদিবাসীদের উপর সঙ্ঘটিত হত্যা ও হামলার শোক ও প্রতিবাদ জানান।

 

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জুম্ম প্রতিনিধিবৃন্দ চলমান আদিবাসী নিপীড়ণের গতি- প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন যে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত মানবাধিকার লংঘন ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত, বিচার ও দোষীদের শাস্তি না হওয়া ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের দায়মুক্তির কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীরা এথনিক ক্লিনজিং আর স্ট্রাকচারাল জেনোসাইডের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ বাংলাদেশের সর্বত্র পাহাড়িবিদ্বেষ উস্কে দেয়া হচ্ছে। এই “হেইট রেটরিক” এর সর্বব্যাপক প্রসারে দেশের কোথাও আর পাহাড়িরা নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন না। এতে করে দেশের জনগনের মধ্যে বিভাজন, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাস তুংগে উঠেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তীকাল হতে আজ পর্যন্ত একটিও  হামলা ও মানবাধিকার লংঘন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। সাম্প্রতিক ঘটনার তদন্ত করতে একটি প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে। এই তদন্ত কমিটির প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে নিহতদের পরিবার।[viii][ix]

অভিযোগ উঠেছে এই তদন্ত কমিটিও জবাবদিহিতামূলক এবং স্বচ্ছ নয়। জাতিগত হত্যা ও হামলার তদন্ত ও বিচার আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী সম্পাদন করা সমীচীন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জিইয়ে রাখার কারণে পৌনঃপুনিক মানবাধিকার লংঘন ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও তা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ঘৃণা ছড়িয়ে ও উস্কানি দিয়ে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে “মব লিঞ্চিং”আর আইন বহির্ভূত হত্যাকান্ড ঘটে আসছে। বাংলাদেশেও গণপিটুনির সংস্কৃতি বিদ্যমান, এমনকি এ ধরনের ঘটনা খোদ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সম্প্রতি ঘটেছে। আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে পর্যবেক্ষণ করছি যে দেশে একটি জন আকাংক্ষার সরকার থাকা সত্ত্বেও ঘৃণা- বিদ্বেষের প্রচার-প্রসার থামছে না। অনলাইনে গুজব ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে আদিবাসীদের উপর হামলার পাঁয়তারা দেখেও কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

দেশে জাতিগত বিদ্বেষ-বিভাজন দূর করতে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। “হেইট রেটরিক” এর বাতাবরনে “হেইট প্রোপাগান্ডার” মাধ্যমে পাহাড়িদের উপর পূণরায় আক্রমণ ঘটে, তার দায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। আমরা আশা করি বর্তমান সরকার জন আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করতে আদিবাসীদের দাবীসমূহ আমলে নেবে এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইঙ্কলুসিভ), জনবৈচিত্র্যময় (ডাইভার্স), বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে পাহাড়িদের উত্থাপিত দাবীসমূহ আমলে নেবে।”

অস্ট্রেলিয়াজুড়ে অবস্থানরত জুম্ম আদিবাসীদের সংগঠন চিটাগাং হিল ট্র্যাক্সটস ইন্ডিজেনাস জুম্ম এসোসিয়েশন অফ অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে ও স্থানীয় সংগঠনের আয়োজনে ধারাবাহিক বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হবে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে। আগামীকাল ৫ অক্টোবর মেলবোর্নে এবং ৯ অক্টোবর ক্যানবেরায় বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করা হবে। এই কর্মসূচির অংশ হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী,এবং বাংলাদেশের প্রধান উপদেস্টার বরাবরে স্মারকলিপি দেওয়ার মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার জুম্ম ডায়াস্পোরা তাদের দাবীনামা তুলে ধরবে।

 

 

 

 

 

 

অস্ট্রেলিয়ান জুম্ম ডায়াস্পোরার দাবীসমূহ:

 

১। আর্মি ও সেটলারের হামলায় নিহতদের পরিবারের ভরণপোষণের আর্থিক দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। সেটলারদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের বসতবাড়ী ও ব্যবসার ক্ষতিপূরণ ও পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

২। তদন্তের নামে প্রহসন নয়; জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে সাম্প্রতিক হত্যাকান্ড, হামলা ও লুটপাটের স্বচ্ছ, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

৩। পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

৪। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন তুলে নিতে হবে।

৫। পার্বত্য চট্টগ্রামের এথনিক জনগোষ্ঠিকে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী নয়, আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে হবে।

৬। মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ সমাজের সর্বস্তরে ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচারকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে।

৭। ঘৃণা-বিদ্বেষের প্রচার বন্ধ করে আদিবাসীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই, দেশে বসবাসের নিরাপত্তা চাই।

[i] খাগড়াছড়িতে রাতভর গোলাগুলি, নিহত ৩ | প্রথম আলো (prothomalo.com)

 

[ii] খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষে তিনজনের মৃত্যু, আহত অনেকে | The Financial Express

[iii] খাগড়াছড়ি, রাঙামাটিতে সংঘাত, নিহত ৪, ১৪৪ ধারা জারি – DW – 20.09.2024

 

[iv] ISPR account on clashes, tension in Khagrachhari, Rangamati | undefined (thedailystar.net)

[v] Gray, Richard A. (1994). “Genocide in the Chittagong Hill tracts of Bangladesh”. Reference Services Review. 22 (4): 59–79. doi:10.1108/eb049231.

[vi] O’Brien, Sharon (2004). “The Chittagong Hill Tracts”. In Shelton, Dinah (ed.). Encyclopedia of Genocide and Crimes against Humanity. Macmillan Library Reference. pp. 176–177.

[viii] ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে খাগড়াছড়িতে সেনা গুলিতে নিহত জুনান চাকমার মায়ের আহাজারি https://www.youtube.com/watch?v=bdoLLTqIEC4

[ix] পাহাড়ে সংঘাত: এক ছেলেকে হারিয়ে আরেক ছেলেকে নিয়ে চিন্তায় মা, https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/217d1528b74e

আরো..