https://www.a1news24.com
৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, দুপুর ১২:০৭

পাঁচবার ফলন দেওয়া ধান পঞ্চব্রীহি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চান ড. আবেদ চৌধুরী

ঢাকা, বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ : দীর্ঘদিন ধরে ধান নিয়ে কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী জিনবিজ্ঞানী ও ধান গবেষক ড. আবেদ চৌধুরী। গবেষণার ফল হিসেবে বোরো জাতের নতুন ধানগাছ উদ্ভাবন করে চমক সৃষ্টি করেছেন তিনি। প্রথমবারের মতো ড. আবেদ চৌধুরী উদ্ভাবিত ‘পঞ্চব্রীহি’র একটি ধানগাছ একবার রোপণ করে তা থেকে বছরে পাঁচবার ফলন পাওয়া গেছে। এ ধান চাষে খরচ কম হয়, কারণ জমি একবার চাষ করতে হয়। বীজতলাও একবার তৈরী করতে হয়। বোরো মৌসুমে জমি প্রস্তুতির সময় সার জমিতে দিতে হয়। পরে প্রয়োজনমতে প্রতি ফলনের আগে-পরে সার দিতে হয় বলেও জানান এ বিজ্ঞানী। আজ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্সেস (CARS) এর উদ্যোগে ও বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (বিএফএফ) -এর সহযোগিতায় “Panchabrihi Multi-Harvest Rice: A pathway to food security and climate mitigation” শীর্ষক এক সেমিনারে মূল বক্তা হিসেবে তিনি এ সকল কথা বলেন।

সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক) প্রফেসর ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশের খাদ্যঘাটতির একটি প্রধান কারণ। অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে কৃষিপ্রধান দেশ হয়েও বাংলাদেশে খাদ্য-সংকট দেখা যায়। অন্যদিকে জমির তুলনায় আমাদের জনসংখ্যা অনেক বেশি। তাই অতিরিক্ত মানুষের খাদ্যচাহিদা মেটাতে আমাদের প্রতিবছর বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। এ পরিস্থিতিতে খাদ্য চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে ধানের ফলন আরো বাড়ানো ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। বর্তমান সময়ে পাঁচবার ফলন দেওয়া ধান পঞ্চব্রীহি আমাদেরকে এক নতুন পথের সন্ধান দিবে বলে আশা করা যায়।

সেমিনারের বিশেষ অতিথি এবং কুলাউড়া উপজেলা (মৌলভীবাজার-২ আসন) সংসদ সদস্য জনাব শফিউল আলম চৌধুরী জানান, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের কৃষি খাতে খুবই মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল অবলম্বন করতে উচ্চফলনশীল ফসলের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন ও ব্যবহার এবং এগুলোর চাষাবাদ বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন।এক্ষেত্রে ড. আবেদ চৌধুরী উদ্ভাবিত ধান পঞ্চব্রীহির বহুল চাষাবাদের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ খাদ্য পুষ্টির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। দেশের কৃষিক্ষেত্রে বৈরী জলবায়ু মোকাবিলা করে পঞ্চব্রীহি ধান আমাদের খাদ্য পুষ্টিমানের ক্ষেত্রে বিশাল ভুমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করেন সাবেক শিক্ষা সচিব এবং বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর মোঃ নজরুল ইসলাম খান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্সেস (CARS) এর পরিচালক অধ্যাপক ড. ইসতিয়াক এম সৈয়দ এর সভাপতিত্বে আয়োজিত এই সেমিনারে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) এর সাধারণ সম্পাদক – মুনির হাসান, বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (বিএফএফ) এর নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোশতাক ইবনে আইয়ুব সহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশন, বাংলাদেশের অর্থায়নে বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন (বিএফএফ) এর বাস্তবায়নে ও বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) এর সহযোগিতায় এক বছর মেয়াদি “Increasing Volume of Early-Harvest and Multi-Harvest Rice Varieties in Moulvibazar”-প্রকল্পের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল এ জাতের ধান মাঠ পর্যায়ে চাষ করা হয়। পরে ধানের এ বীজ বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

২০১০ সালে প্রথম কুলাউড়া উপজেলার হাজিপুর ইউনিয়নের কানিহটি গ্রামে ২৫ বর্গমিটার জমিতে ২০টি ধানের জাত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন আবেদ চৌধুরী। পরে তিন বছরে ২০টি ধানের জাত নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যায় নির্দিষ্ট ধরনের এ জাত একই গাছে পাঁচবার ফলন দিতে সক্ষম। স্থানীয় জাতের ধানের সঙ্গে উন্নত মানের ধানের বীজ সংকরায়ন করে এই উচ্চফলনশীল ধানের জাত পাওয়া যায়। পঞ্চব্রীহি ধান চাষে প্রথমবার ১১০ দিন পর ফলন আসে। পরের ফলন আসে ৪৫ দিন অন্তর। একবার বোরো, দুবার আউশ ও দুবার আমন ধানের ফলন পাওয়া যাবে। পঞ্চব্রীহি ধান প্রথমবার হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয় চার টন। ধানের চারা প্রতি ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হয়। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কৃষি উর্বর জেলা মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রামের দিগন্ত জোড়া আমন ফসলির মাঠের একাংশে প্রায় দুই বিঘা জমিতে উৎপাদন হয়েছে পাঁচ ফসলি ধান। এই গ্রামের সন্তান জীনবিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী এই পাঁচ ফসলি ধানের উদ্ভাবক। অবিশ্বাস্যভাবেই এই ধান একবার রোপণের পর পাঁচবার কাটা যায়। বছরে এই ধান গাছ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচবার ফসল পাওয়া যায়। একই সঙ্গে নতুন জাতের এ ধান যাতে সারা দেশে চাষাবাদ করা যায় সেই চেষ্টা চালাচ্ছেন।

তবে শুরুটা কীভাবে হয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা কৃষির ওপর খুব নির্ভরশীল ছিলাম। আমি দেখেছি যারা ধান চাষ করে তারা উন্নত জীবনযাপন করতে পারেন না। এটা আমার জন্য খুব পীড়াদায়ক ছিল। কারণ আমরা কৃষিনির্ভর পরিবারের মানুষ দেখেছি দেশে খুব অবহেলিত। মানুষ শুধু চায় কম দামে ধান পেতে। কিন্তু কৃষকরা ধানের মূল্য পাচ্ছে না। তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি আমার ব্যক্তিগতভাবে কৃষিতে কীভাবে আয় বাড়ানো যায় ব্যয় কমানো যায় এটা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করি। আমার চিন্তা ছিল জমিতে একবার ধান রোপণ করে একাধিকবার ফসল কাটব। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে, বাড়বে আয়। আমি এই জিনিসটাই করতে চেয়েছি। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় আমি করতে পেরেছি।

আবেদ চৌধুরী আরও জানান, যে জাতগুলোর ধান পাকার পর কেটে নিয়ে গেলে আবার ধানের শীষ বের হয়, সেগুলো তিনি আলাদা করেন। এভাবে ১২টি জাত বের করেন। তিন বছর ধরে জাতগুলো চাষ করে দেখলেন, নিয়মিতভাবে এগুলো দ্বিতীয়বার ফলন দিচ্ছে। তারপর তিনি শুরু করেন একই গাছে তৃতীয়বার ফলনের গবেষণা। চারটি জাত একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দিচ্ছে। এই চারটি জাতের ওপর ১০ বছর ধরে চলছে গবেষণা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বোরো ধানের এই চারটি জাত দুই বিঘা জমিতে রোপণ করা হয়। পরিমাণমতো সার প্রয়োগ করা হয়। সঠিকভাবে সেচ ও পরিচর্যা করার পর ১১০ দিনের মধ্যে ৮৫ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার উচ্চতার গাছে ফসল আসে। পরে মাটি থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় পরিকল্পিতভাবে ওই ধান কেটে ফেলা হয়। মে মাসের প্রথম দিকে প্রথমবার কাটা ধানে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয়েছে চার টন। তারপর থেকে ৪৫ দিন অন্তর প্রতিটি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি কখনো দুই টন, কখনো তিন টন ফলন এসেছে। সব জাত হেক্টরপ্রতি প্রায় ১৬ টন ফলন দিয়েছে। যেহেতু পাঁচবার চাষ হয় সেহেতু ‘পঞ্চব্রীহি’ নামটাই চূড়ান্ত করা হয়।

তিনি বলেন, বছরের যে কোনো সময়ে এ ধান রোপণ করা যায়। এখন পরের ধাপগুলোতে কিছুটা কম উৎপাদন হচ্ছে। আমার চেষ্টা থাকবে, আরও বেশি ফলন বের করার। এ ধানের বীজ সংগ্রহ সহজ। কৃষকরা নিজেরাই তা করতে পারবেন। অন্য ধানের মতো বীজতলায় রোপণের পর চারা তুলে চাষ করতে হয়। পঞ্চমবার ফলন দেওয়া ধান উদ্ভাবন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে আবেদ চৌধুরী বলেন, এর আগে আমি অন্য ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। দুবার ফসল হয়, এমন ধানও উদ্ভাবন করেছিলাম; যাকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া রাইস টুআইস বলেছে। আবার অনেকে জীবন বর্ধিত ধান বলেছে। এই প্রথম সারা বছর আমার অন্য আরেকটি ধানের জাত মাঠে থাকল। এ ধানের চারা ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে রোপণ করতে হয়। ফলে গাছটি মাটি থেকে ভালোভাবে শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে এবং একটি ধান গাছ থেকে আরও বেশ কয়েকটি ধান গাছ গজাতে থাকে।

ড. আবেদ চৌধুরী একজন জিনগবেষক। একদল অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীর সঙ্গে তিনি ফিস (ইন্ডিপেনডেন্ট সিড) জিন আবিষ্কার করেন। তিনি লাল রঙের চাল ও রঙিন ভুট্টাও উদ্ভাবন করেছেন। তার ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার প্রতিরোধক রঙিন ভুট্টা বিশ্বব্যাপী আলোচিত। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদন ও ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে গবেষণা করছেন। কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামের সন্তান আবেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধানবিজ্ঞানী হিসেবে ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করে কাটিয়ে দিয়েছেন ২০ বছর। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ রকমের নতুন ধান উদ্ভাবন করেছেন। গ্রামের বাড়ি কানিহাটিতে তুলেছেন কৃষি খামার। তার নামে আবেদ ধানও এলাকায় চাষ করে সফলতা পেয়েছেন কৃষকরা। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

আরো..