অনলাইন ডেস্ক- বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দেশনাটকের ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধের ঘটনায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীরা৷ সোমবার (৪ নভেম্বর) বিকেল ৫টায় ঢাকার সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির মূল ফটকের সামনে ব্যানার হাতে সমবেত হয়ে ছয়টি দাবি উত্থাপন করেন তারা৷
নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়াকে ‘ন্যাক্কারজনক’ অভিহিত করা হয় সমাবেশের শুরুতে৷ সেখানে বলা হয়, ‘‘পরিকল্পিতভাবে এটি ঘটানো হয়েছে৷ আমরা সবাই এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাই৷ এমন ঘটনা আর এই বাংলায় হতে দেওয়া হবে না৷ আমরা সোচ্চার থাকবো সবসময়৷ নাট্যকর্মীদের জায়গা শিল্পকলা একাডেমি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের৷ সেনাবাহিনী কিংবা পুলিশের হাতে শিল্পকলা একাডেমি ছেড়ে দিতে চাই না৷ আমরা নিজেরাই এই জায়গা রক্ষা করতে চাই৷’’
সমাবেশে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বটতলা নাট্যদলের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মদ আলী হায়দার৷ বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীদের পক্ষ থেকে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি৷
১. দেশনাটকের বন্ধ প্রদর্শনী সাত দিনের মধ্যে ফেরত দিতে হবে৷ নির্বিঘ্নে যেন সেই প্রদর্শনী হয়, সেজন্য আমরা নাট্যকর্মীরা পাহারা দেবো৷
২. সেনাবাহিনী শিল্পকলা একাডেমিতে থাকার কারণে সাধারণ নাট্যকর্মীদের যাতায়াত বন্ধ, তারা যদি শিল্পকলার বিপদে নিরাপত্তা না দেয়, তাহলে শিল্পকলায় আমাদের নাট্যকর্মীদের যাতায়াত অবাধ করুন৷ সেনাবাহিনীকে শিল্পকলা একাডেমি থেকে সাত দিনের মধ্যে সরাতে হবে৷
৩. সাধারণ নাট্যকর্মী, দর্শক ও নাগরিকদের জন্য শিল্পকলা একাডেমিকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে৷
৪. সব মিলনায়তন খুলে দিয়ে নাট্যচর্চার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে হবে৷
৫. শিল্পকলা পরিষদের আমলা-নির্ভরতা কমাতে হবে৷
৬. শিল্পকলা একাডেমিতে থিয়েটারগুলোর প্রদর্শনী বরাদ্দে স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে৷
কেন নাট্যকর্মীরা এত প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন- জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন, ‘‘শিল্প-সংস্কৃতিতে নাটক বন্ধ হওয়া ও বন্ধ করা উভয়ই অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য হয়৷ বাইরের মানুষ এটা সহজে না-ও বুঝতে পারেন ও নাটক বন্ধের দাবি করতে পারেন৷কিন্তু তাদের দাবিতে নাটক বন্ধ করে দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে, যার দায় শিল্পকলা একাডেমির৷ কারণ, শিল্পকলার প্রত্যেকের দায় আছে যে-কোনো মূল্যে প্রদর্শনী করতে থাকা দলকে নাটক শেষ হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা দেওয়া৷ সেই নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার দায় শিল্পকলার মহাপরিচালক মাথা পেতে নিয়েছেন৷ তার দায়িত্বশীলতা আরো মহিমান্বিত হতে পারতো, যদি এই সংঘটিত হিংস্র আচরণকে শিল্পকলা ঠেকাতে পারতো৷ পুরো বিষয়টির মধ্যে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, শিল্পকলায় প্রবেশ করে দুর্বৃত্তরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিকিট কাউন্টারসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালিয়েছে৷ কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনীকে ডাকা হয়নি৷ এ ব্যর্থতা শিল্পকলার৷’’
গত ২ নভেম্বর জাতীয় নাট্যশালায় পৌরাণিক প্রেমের গল্প নিয়ে দেশনাটকের নন্দিত প্রযোজনা ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের ১২৭তম প্রদর্শনী শুরু হওয়ার আগে থেকে সংগঠিত একদল তরুণ শিল্পকলা একাডেমির মূল ফটকে এসে নানাভাবে নাটক বন্ধের তৎপরতা চালায়৷ দেশনাটকের একজন সদস্যের একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনার জন্ম হয়েছে বলে জানা যায়৷
সমাবেশে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘‘নাটকের দল একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান৷ সাধারণত সেখানে সব রাজনৈতিক দল, মত ও আদর্শের মানুষের সহাবস্থান থাকে৷ শিল্পচর্চায় এসব খুব বড় বাধা নয়৷ বরং এই সহঅবস্থান আর সহিষ্ণুতার চর্চাই থিয়েটারের মূল শক্তি৷ কারো ব্যক্তিগত মতামতের দায় তার দলের ঘাড়ে দেওয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি স্বৈরশাসকের আমলের আচরণ৷ বিগত আমলে বিভিন্ন দলের, বিভিন্ন মানুষের ফেসবুক স্ট্যাটাসের জেরে তার দলকে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে বিভিন্নভাবে হেনস্তা ও নিপীড়ন করা হয়েছে৷ একই চর্চা নতুন বাংলাদেশে চালু হওয়ার কোনও সুযোগ নেই৷’’
নাটক বন্ধের ঘটনায় শিল্পকলা একাডেমিকে দ্রুত আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রাচ্যনাট নাট্যদলের অভিনেতা, নাট্যকার ও নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম৷ তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘সেদিন যারা সন্ত্রাস করতে এসেছিল, তারা সফল হয়ে গেলে সারা দেশে নাটক, সংস্কৃতি, গান-বাজনার ওপর ভয়াবহ আক্রমণ হতে যাচ্ছে৷ তাই তাদের চিহ্নিত করতে হবে৷ গুটিকয়েক লোকের এত সাহস হওয়ার কথা নয়৷ আমরা পরাজিত হতে চাই না৷ সেদিন নাটক দেখতে আসা দর্শকরা আক্রান্ত হয়েছে৷ নাটক কেন দেখেছে, সেজন্য তাদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে৷ তারা নিগৃহীত হয়েছে৷ দুর্বৃত্তরা শক্তিশালী, তাদের পেছনে কেউ নাই ভাববেন না৷ তাদের ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী আছে৷ তারা কারো ইন্ধনে এসেছিল কিনা সেটার অনুসন্ধান করা দরকার৷ তাদের খুঁজে বের করা শিল্পকলার দায়িত্ব৷’’
সমাবেশে ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের রচয়িতা ও নির্দেশক মাসুম রেজা বলেন, ‘‘আমি অনেক জোর গলায় বক্তব্য দিতে জানি৷ কিন্তু আজ আমার উচ্চকণ্ঠ একেবারেই ম্রিয়মান হয়ে গেছে৷ কারণ, থিয়েটার আজ লজ্জিত৷ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লজ্জিত, তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন৷ আমি কোনো দাবি নিয়ে আসিনি, কারো অনূকম্পা নিতে কিংবা কোনো ভয়-ভীতি মনে নিয়ে আসিনি৷ আপনারা কল্পনা করুন, একটি দেশের জাতীয় শিল্পকেন্দ্রের গেটে লেখা আছে একজন ব্যক্তিকে একদল মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার কথা৷ পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির নেই৷ এটা যদি দেশে ও বাইরের গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয়, শিল্পকলা একাডেমির ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমন ব্যানারে কি সরকারের ভাবমূর্তি বাড়লো, নাকি ক্ষুন্ন হলো? এটি কারা করেছেন আমরা জানি না৷ কিন্তু এ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে৷ বাংলাদেশের কোনো শিল্পকলায় এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়৷’’
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালককে সেদিনের পুরো ঘটনা পর্যালোচনা করার আহ্বান জানান মাসুম রেজা৷ তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি৷ কারা নেপথ্যে ছিল জানা জরুরি৷ নিরপেক্ষ তদন্ত যেন হয়, সেই অনুরোধ জানাই মহাপরিচালককে৷ একইসঙ্গে শিল্পকলার কাছ থেকে আমাদের নাট্যকর্মীদের জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা জানতে চাই৷’’
মঞ্চনাটক মাঝপথে বন্ধ হওয়াকে বাংলাদেশের ভয়াবহ ইতিহাস হিসেবে দেখছেন বটতলার নাট্যকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা নিত্রা৷ সমাবেশে তিনি বলেন, ‘‘থিয়েটারের আলাদা শক্তি ও সংস্কৃতি আছে৷ আমাদের বিভিন্ন দলের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য আছে৷ তবুও আমাদের মধ্যে এক অন্যরকম সম্পর্ক আছে৷ আমরা থিয়েটার করা সবাই একটা পরিবার৷ অথচ গণঅভ্যুত্থানের পর সারা দেশের সমস্ত কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলেও শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনগুলো পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়নি৷ নির্ধারিত কয়েকটি দিনে নাট্য প্রদর্শনী হচ্ছে৷ নাট্যকর্মীদের অবাধ যাতায়াত না থাকায় শিল্পকলা একাডেমি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে৷ তাই আমাদের ছয় দফা দাবি পূরণ করে নাট্যাঙ্গনে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দিন৷’’
তবে দেশনাটকের সদস্য এহসানুল আজিজ বাবু ফেসবুক পোস্টে বর্তমান সরকারপ্রধানসহ অন্যান্য উপদেষ্টা ও ছাত্র সমন্বয়কদের ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন প্রকাশ ও তাদের রাজাকার আখ্যা দিয়ে অমার্জিত, অশালীন ও ভদ্রতার সীমা পার করেছেন বলে মনে করেন থিয়েটারকর্মীরা৷ তবে বক্তাদের মন্তব্য, ‘‘তার ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য দেশনাটককে দায়ী করা যাবে না৷ নাটক বন্ধ করা বা এর দাবি তোলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ যদি দেশনাটকের সদস্যের ফেসবুকে লেখা বক্তব্য কারো জন্য মানহানিকর হয়ে থাকে, তাহলে তা নিয়ে আলাদাভাবে বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণের সুযোগ নাগরিকদের আছে৷ তবে আগের আমলে যেমন কিছু হলেই শেখ হাসিনা ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়ে যাওয়ার অপরাধে মানুষকে শাস্তি দেওয়া হতো, সে প্রথার পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না৷’’
মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন, ‘‘এহসানুল আজিজ বাবুর মতো নাট্যাঙ্গনের বাইরে যার তেমন কোনো পরিচিতিই নাই, তাকে কেন্দ্র করে এত বড়ভাবে সংগঠিত হওয়া কেবল বাইরের লোকের পক্ষে সম্ভব নয়৷ আর সেনাবাহিনীর কারণে যেহেতু সাধারণ নাট্যকর্মীদের প্রবেশাধিকার শিল্পকলায় সীমিত, কাজেই এই পুরো ঘটনায় পতিত প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে এখনো টিকে থাকা কোনো গ্রুপ বা নতুন করে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ করা অন্য কোনো অংশের ভূমিকা থাকার শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷’’
বক্তারা আরও বলেন, শিল্পকলা একাডেমি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যার লক্ষ্য হলো জাতীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উন্নয়ন৷ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রসারের মাধ্যমে সকল মানুষের জন্য শিল্প-সংস্কৃতির প্রবাহ তৈরি করে শিল্পকলা একাডেমি৷ এমন একটি বাংলাদেশ গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে নিয়মিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনের পরিবেশ দেওয়া ও নিরাপদে সেই পরিসরে যেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন কাজ করতে পারে সেটি নিশ্চিত করা শিল্পকলার প্রধানতম দায়িত্ব৷
প্রতিবাদ সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের নির্দেশক সাইদুর রহমান লিপন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক কামালউদ্দিন কবির, দেশনাটকের নাট্যকর্মী নাজনীন হাসান চুমকী, বটতলা নাট্যদলের প্রধান কাজী রোখসানা রুমা, অপেরা নাট্যদলের প্রধান নাহিদ স্মৃতি, আলোক নির্দেশক নাসিরুল হক খোকন, থিয়েটার বায়ান্নর জয়িতা মহলানবীশ, মেঠোপথ থিয়েটারের শামীম আরা মুক্তা৷
গত ৩ নভেম্বর অনলাইনে সংবাদ সম্মেলন করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ৷ তিনি নিজের দায় মেনে নিয়ে বলেন, ‘‘আমি একটা খণ্ডযুদ্ধ করেছি৷ অনেক চেষ্টা করেছি নাটকের প্রদর্শনী যেন হয়৷ কিন্তু আমি হেরে গেছি৷ একটা খণ্ডযুদ্ধে হেরে গেছি৷ কিন্তু মূল যুদ্ধটা এখনও হারিনি৷”
২০১৬ সালের জুলাই মাসে তীরন্দাজের ‘কণ্ঠনালীতে সূর্য’ নাটকের প্রদর্শনী শুরুর আগমুহূর্তে বন্ধ ঘোষণা করা হয়৷ কারণ, নাটক শুরুর আগে ‘সুন্দরবনের ওপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরূপ প্রভাব’ বিষয়ে আলোচনা সভা হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু সেই বিষয়ে আগাম অনুমতি না থাকায় তীরন্দাজ নাট্যদলের প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয় শিল্পকলা একাডেমি৷ তখন মহাপরিচালক ছিলেন লিয়াকত আলী লাকী৷