https://www.a1news24.com
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ভোর ৫:৫৩

ডাঃ মাহাবুবুর হার্টে রিং পরান একটা আর টাকা নেন তিনটার!

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রিং কান্ড!
অনিরুদ্ধ রেজা: বিধি ভঙ্গ করে ৫ বছর ধরে রিং বাণিজ্য করছেন সরকারী মেডিকেলে, ভুয়া ডিগ্রী, পদবী ব্যবহার করে এই হৃদরোগ চিকিৎসকের বেশভূষা-চেহারা দেখে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেননা না যে তিনি রোগীদের সঙ্গে এমন প্রতারণা করতে পারেন।
হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং (স্টেন্ট) লাগিয়ে তিনটির টাকা নেন। কখনো রিং না লাগিয়েই সার্জারি করে রিংয়ের টাকা আদায় করেন। রিং পরানোর দরকার না হলেও রোগীকে ‘অতংকিত’ করে রিং পরান। চিকিৎসকের রিং বিক্রির নিয়ম না থাকলেও তিনি নিজেই রিং বিক্রি করেন। এমনই অভিযোগ উঠেছে একজন হৃদরোগ চিকিৎসক ডা. মো. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট তিনি। রংপুর দুর্নীতি দমন কমিশন অফিসে ভুক্তভোগী ডা. মাহাবুবের প্রতারণার শিকার দুজন রোগী এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগ পত্র অনুযায়ী জানা যায়, তিনি গত পাঁচ বছর ধরে হার্টে সাজারী করে নিজেই রিং বিক্রি করে বসালেও কর্তৃপক্ষ এ অনিয়মের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
অভিযোগের কপি দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিএমডিসি, রামেক হাসপাতাল, রংপুর সিভিল সার্জন অফিসেও ডাকযোগে এবং সরাসরি পাঠিয়ে ডাঃ মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়ে অভিযোগ করেন ওই দুইজন ভুক্তভোগী মোহা, মশিউর রহমান ও আতোয়ার রহমান। এই দুই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠনের নিমিত্তে সিভিল সার্জন অফিস রংপুর গত ২৬ নভেম্বর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর এক চিঠিতে তদন্ত কমিটির একজন সদস্যের নাম পাঠাতে অনুরোধ করেছে।
গাইবান্ধা সদরের কুমারপাড়া গ্রামের আতোয়ার হোসেন (৪৫) তার ওই লিখিত অভিযোগে বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডাঃ মাহাবুবুর রহমান প্রতারণার মাধ্যমে উক্ত হাসপাতালে আমার হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং (স্টেন্ট) পরিয়ে তিনটি রিংয়ের টাকা আদায় করে আত্মসাত করেছেন। ডাঃ মাহাবুবুর রহমান রিং পরানোর যে সিডি দিয়েছেন তাতে রিং লাগানোর কোন নজির নেই তবে হাসপাতালের রেজিস্ট্রার খাতায় একটা রিং পরানোর রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু ডাঃ মাহাবুবুর তিনটি রিং লাগোনোর কথা বলে আমার নিকট থেকে তিন লক্ষ বিশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।”
আতোয়ার হোসেন বলেন,গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর তার হার্ট অ্যাটাক হলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডাঃ মাহাবুবুর রহমানের অধীনে ভর্তি হন। এনজিওগ্রাম করে ডা. মাহাবুবুর জানান যে,হার্টের রক্তনালীতে তিনটি ব্লক আছে এজন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে হবে। এর পর নয় শতক জমি বিক্রি করে তিনি তিনটি রিংয়ের জন্য মেডিকেলের এমএলএস শহিদুল ইসলামের সিন্ডিকেটে তিন লক্ষ বিশ হাজার টাকায় তিনটি রিং পরাতে রাজী হন ডা. মাহাবুবুর। রিং পরানোর পর অবস্থার উন্নতি না হলে কয়েকদফা তাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ডাঃ মাহাবুবুরের অধীনে। এরপরও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিলে আতোয়ার এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আরেক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোঃ হাসানুল ইসলামের অধীনে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি হয়ে সুস্থ হন। এসময় জানতে পারেন তার হার্টের রক্তনালীতে একটি রিং পরানো হয়েছে।
অন্য দিকে রংপুরের গঙ্গাচড়ার আরেক ভুক্তভোগীর ছেলে মোহা, মশিউর রহমান তার অভিযোগপত্রে বলেন,যে পেটে ব্যাথা হলে তার মাকে ডা. জিয়াউর রহমানের নিকট দেখাই রংপুর কসিরউদ্দিন মেডিকেলে এবছরের ৫ সেপ্টেম্বর। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পিত্তথলির অপারেশন করাতে হবে বলে জানান এবং অপারেশনের আগে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের নিকট চেক করে নিতে বলেন। ১১ সেপ্টেম্বর তার মাকে নিয়ে ডাঃ মাহাবুবুর রহমানের নিকট রংপুর সেন্ট্রাল হাসপাতালে দেখালে তিনি এনজিওগ্রাম করাতে বলেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ডা. মাহাবুবুর রহমান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনজিওগ্রাম করেন এবং বলেন যে তার মায়ের হার্টের রক্তনালীতে ৭৫ শতাংশ ব্লক আছে তা এক লক্ষ আশি হাজার টাকা দিয়ে রিং (স্টেন্ট) পরাতে হবে।
মশিউর রহমান তার অভিযোগপত্রে আরো বলেন, “আমাদের সন্দেহ হলে ঢাকা ন্যাশন্যাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ডা. বদিউজ্জামান স্যারকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর’২৪ উক্ত এনজিওগ্রামের সিডি (রেজি নং ১২৫২২/৩২) দেখালে তিনি বলেন যে,তার মায়ের হার্টে কোন প্রকার ব্লক নেই। এরপর রংপুরে এসে গত ১৫ই অক্টোবর’২৪ তারিখ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ হাসানুল ইসলামকে দেখালে তিনিও বলেন যে,তার মায়ের হার্টের রক্তনালীতে কোন ব্লক নেই। তবে তিনি সামান্য কিছু ওষুধ খেতে পরামর্শ দেন। এতে তার মায়ের যে সমস্যাগুলি ছিল সেগুলো ভালো হয়ে যায়। অতপর গত ৭ নভেম্বর ‘২৪ তারিখে ডা. মোহা, মিজানুর রহমানের অধীনে পিত্তথলির অপারেশন করান তিনি তার মায়ের।
এভাবে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে ডা. মাহাবুবুর রহমান রংপুর সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বসে ব্যবসা ও অবৈধ উপার্জন করছেন এবং অভিযোগকারী তার অভিযোগ পত্রে আরও উল্লেখ করেন যে,শুনেছি তিনি এরকম প্রতারণা করে প্রতিনিয়তই রিং বিক্রি করেই চলছেন। কিন্তু উক্ত চিকিৎসকের এই রূপ ভয়ংকর ও অনিয়ম ও দূর্নীতি অব্যাহত থাকলেও দেখার কেউ নাই।
সূত্র জানায়,রামেক হাসপাতালে প্রতিনিয়তই রিং বাণিজ্য করে যাচ্ছেন ডা. মাহাবুব। তিনি এজন্য বিজ্ঞাপনও দেন তার ভিজিটিং কার্ড ও ফাইল ফোল্ডারে। “সুখবর সুখবর সুখবর। আর নয় ঢাকা, আর নয় ইন্ডিয়া। এখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই অতি অল্প খরচে হার্টের এনজিওগ্রাম, হার্টেরর রক্তনালীতে স্টেন্ট (রিং) বসানো (এনজিওপ্লাস্টি ও স্টেন্টিং) মাইট্রাল ভালভুলোপ্লাস্টি ও হার্টের পেসমেকার স্থাপন করছেন ডাঃ মোঃ মাহাবুবুর রহমান।” রিং বিক্রি বাড়াতে এভাবেই নিজের বিজ্ঞাপন দেন ডা. মাহাবুব যা আইন অনুযায়ী মারাত্মক অপরাধ।
তিনি তার ভিজিটিং কার্ডে ও নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিএমডিসির অনুমোদনহীন এমডি (কার্ডিওলজি), এফএসিসি (আমেরিকা) এ ধরনের ভুয়া ডিগ্রী লিখে প্রলুব্ধ ও প্রতারণা করে চলছেন রোগীদের সাথে প্রতিনিয়ত ।
বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০ এর ধারা ২৯(১) বলা হয়েছে: “এই আইনের অধীনে কোন মেডিকেল চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক এমন কোন নাম, পদবী, বিবরণ বা প্রতীক এমনভাবে ব্যবহার বা প্রকাশ করিবেন না যাহার ফলে তাহার কোন অতিরিক্ত পেশাগত যোগ্যতা আছে মর্মে কেহ মনে করিতে পারে, যদি না উহা কোন স্বীকৃত মেডিকেল চিকিৎসা শিক্ষা যোগ্যতা বা স্বীকৃত ডেন্টাল চিকিৎসা- শিক্ষা যোগ্যতা হইয়া থাকে।” এই ধারা ভঙ্গ করলে সর্বোচ্ছ তিন বছর কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।
আরো..