https://www.a1news24.com
১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রাত ৩:৫৮

চাঁদে জমির দখল নিতে হুলস্থূল, কী হচ্ছে আসলে?

অনলাইন ডেস্ক: মানুষ এখন চাঁদের উপর আধিপত্য বিস্তারের তোরজোড়ের মধ্যে রয়েছে। এরইমধ্যে অনেক দেশ ও সংস্থা চাঁদের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মহাকাশের আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে।বিবিসি বাংলা

আমরা তাহলে চন্দ্র অভিযানের এই নতুন যুগের জন্য প্রস্তুত?

এই সপ্তাহে, চাঁদের পৃষ্ঠে উড়ানো চীনা পতাকার ছবি পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে। এ নিয়ে দেশটি চতুর্থবারের মতো চাঁদে অবতরণ করেছে।

সেই সঙ্গে, এটি এমন এক অনুসন্ধান অভিযান যেখানে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো মহাকাশযান চাঁদের সুদূরে পৌঁছেছে এবং সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে।

গত ১২ মাসে, ভারত এবং জাপানের মহাকাশযানও চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে, আমেরিকান কোম্পানি ‘ইনটুইটিভ মেশিনস’ চাঁদে ল্যান্ডার স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রথম বেসরকারি কোম্পানি হয়ে ওঠে। আরও অন্যান্য কোম্পানি এই তালিকায় জায়গা করার অপেক্ষায় আছে।

এদিকে, নাসা চাঁদে মানুষ পাঠাতে চায়। আর্টেমিস প্রকল্পের মহাকাশচারীরা ২০২৬ সালের মধ্যে চাঁদে অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

চীন বলেছে যে তারা ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠাবে। তবে তারা ক্ষণস্থায়ী সফরের পরিবর্তে চাঁদে স্থায়ী ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা করছে।

কিন্তু নতুন মহা-শক্তির রাজনীতির যুগে, মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা কি পৃথিবীতে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে এবং সেই দ্বন্দ্ব চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে?

কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক জাস্টিন হলকম্ব, সতর্ক করে বলেছেন, চাঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব শিগগিরই মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হতে চলেছে। মহাকাশ অনুসন্ধানের গতি এখন আমাদের নির্ধারিত আইনকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের একটি চুক্তিতে বলা হয়েছে যে কোনো জাতি চাঁদের মালিক হতে পারে না।

আউটার স্পেস নামের একটি চুক্তিতে বলা হয়েছে যে চাঁদ সবার জন্য এবং চাঁদে যেকোনো অভিযান গোটা মানবজাতির কল্যাণের জন্য এবং মানব জাতির স্বার্থে পরিচালনা করা উচিত।

আউটার স্পেস চুক্তিটি বেশ শান্তিপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক মনে হলেও এর উদ্দেশ্য সহযোগিতামূলক ছিল না। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা করা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সে সময়, মহাকাশও এই দুই দেশের একটি সামরিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দেয়।

এ কারণে আউটার স্পেস চুক্তির মূল অংশ জুড়ে ছিল কোনো পারমাণবিক অস্ত্র মহাকাশে পাঠানো যাবে না। এতে ১০০টিরও বেশি দেশ সই করে সম্মতি জানায়।

তবে বর্তমান মহাকাশ যুগটি তখনকার মহাকাশ যুগের চাইতে আলাদা ছিল।

এরমধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো চাঁদে মিশন পাঠানো এখন আর জাতীয় প্রকল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি কোম্পানিগুলোর জন্যও একটি প্রতিযোগিতার খাতে পরিণত হয়েছে।

জানুয়ারিতে, পেরেগ্রিন নামে একটি মার্কিন বাণিজ্যিক মিশন ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা চাঁদে মানুষের ছাই, ডিএনএ-এর নমুনা এবং ব্র্যান্ডিংসহ একটি স্পোর্টস ড্রিংক নিয়ে যাবে।

কিন্তু জ্বালানির ট্যাংক ফুটো হয়ে যাওয়ায় সেই অভিযান তার অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি।

কিন্তু এসব জিনিস মহাকাশে নেওয়ার সাথে আদৌ মানবতার সেবার কোনো সম্পর্ক আছে কি না অর্থাৎ অভিযানটি আউটার স্পেস চুক্তির বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল কি না তা নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

মহাকাশ বিষয়ক আইনজীবী এবং ফর অল মুনকাইন্ডের প্রতিষ্ঠাতা মিশেল হ্যানলন বলেছেন, আমরা চাঁদে জিনিসপত্র পাঠাতে শুরু করেছি কারণ আমরা এটি করতে পারি, এর পেছনে আর কোনো কারণ নেই।

ফর অল মুনকাইন্ড সংস্থা মূলত অ্যাপোলো অবতরণ সাইটগুলিকে রক্ষায় কাজ করছে।

মিশেল হ্যানলন আরও বলেন, এখন চাঁদ আমাদের নাগালের মধ্যে চলে আসছে এবং এখন আমরা একে অপব্যবহার করতে শুরু করেছি।

বেসরকারিভাবে মহাকাশ কর্মসূচি বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও, হাতে গোনা কয়েকটি দেশ এর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

লন্ডনের ইন্সটিটিউট অফ স্পেস পলিসি অ্যান্ড ল-এর পরিচালক প্রফেসর সাইদ মোস্তেহসার বলেছেন, কোনো কোম্পানি যদি মহাকাশে যেতে চায় তাহলে অবশ্যই কোনো রাষ্ট্রের অনুমোদন নিতে হবে, যা আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়।

চাঁদের পৃষ্ঠে পৌঁছে যাওয়া দেশের অভিজাত ক্লাবে যোগ দেয়াও বেশ মর্যাদার ব্যাপার।

ভারত এবং জাপান মহাকাশ অভিযানে সাফল্য পেলে তারাও, বিশ্বব্যাপী মহাকাশচারীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি করতে পারে।

কোনো দেশ মহাকাশ শিল্পে সফল হতে পারলে তাদের অর্থনীতিতে উদ্দীপনা দেখা দেয়। কেননা এর ফলে উদ্ভাবনের জগত প্রসারিত হয়, চাকরির বাজার তৈরি হয়।

কিন্তু চন্দ্রাভিযান এর চাইতেও বড় কিছু দিতে পারে- এর প্রাকৃতিক সম্পদ।

চাঁদকে ওপর থেকে রুক্ষ আর অনুর্বর দেখালেও, এর ভেতরটা খনিজ সম্পদে ঠাসা।

যার মধ্যে বিরল জাতের মাটি, লোহা, টাইটানিয়ামের মতো ধাতু এবং হিলিয়াম রয়েছে, যা সুপারকন্ডাক্টার থেকে চিকিৎসা সরঞ্জাম পর্যন্ত সবকিছুতে ব্যবহৃত হয়।

এই সব সম্পদের মূল্য আনুমানিক শত শত কোটি ডলার থেকে লাখ লাখ কোটি ডলারের মতো।

এ থেকে সহজেই ধারণা করা যায় যে কেন কেউ কেউ চাঁদকে প্রচুর অর্থ উপার্জনের জায়গা হিসেবে দেখে। তবে এটাও ঠিক যে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ।

তবে চাঁদের এই প্রাকৃতিক সম্পদগুলো আহরণ করতে মানুষের যে সক্ষমতা দরকার তা থেকে মানুষ এখনও অনেক দূরে রয়েছে।

১৯৭৯ সালে, একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ঘোষণা করা হয়েছিল যে কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থা চাঁদের সম্পদের মালিকানা দাবি করতে পারবে না।

কিন্তু এই ঘোষণা তেমন জনপ্রিয় হয়নি- শুধুমাত্র ১৭টি দেশ এতে অংশ নেয়। যেসব দেশ চাঁদে পৌঁছানোর দাবি করেছে. যেমন- যুক্তরাষ্ট্র. তারা ওই ১৭ দেশের মধ্যে ছিল না।

প্রকৃতপক্ষে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালে একটি আইন পাস করে যেখানে তারা তাদের নাগরিক এবং শিল্পকে যেকোনো মহাকাশ সামগ্রী নিষ্কাশন, ব্যবহার এবং বিক্রি করার অনুমতি দিয়েছে।

এ নিয়ে মিশেল হ্যানলন বলেছেন, এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচণ্ড আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে, অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি একই ধরনের আইন প্রণয়ন করতে শুরু করে। লাক্সেমবার্গ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান এবং ভারত অনুরূপ জাতীয় আইন জারি করে।

আশ্চর্যজনকভাবে, যে সম্পদটির চাহিদা সবচেয়ে বেশি হতে পারে বলে ভাবা হয়েছে তা হলো: পানি।

চাঁদের এমন আরও অনেক কিছুই আছে- চাঁদের মেরুতে বিভিন্ন গর্তে হিমায়িত জমাট বাঁধা পানির মজুদ রয়েছে, এসব গর্তগুলোয় সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না।

ভবিষ্যৎ দর্শনার্থীরা পান করার জন্য চাঁদের এই পানি ব্যবহার করতে পারে, এই পানি অক্সিজেন তৈরি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

এমনকি মহাকাশচারীরা অক্সিজেন থেকে হাইড্রোজেনকে আলাদা করে রকেটের জ্বালানি তৈরি করতে এটি ব্যবহার করতে পারে।

এভাবে তারা তাদের চাঁদ থেকে মঙ্গল গ্রহে এবং তার বাইরেও ভ্রমণ করতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্র এখন চন্দ্রাভিযান এবং চাঁদকে শোষণ করার কিছু নতুন গাইডিং নীতি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে৷

আর্টেমিস অ্যাকর্ডসের মতে, চাঁদে সম্পদ আহরণ এবং ব্যবহার করা উচিত। তবে সেটা এমনভাবে করা উচিত যাতে মহাকাশের চুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। এজন্য কিছু নতুন নিয়মের প্রয়োজন হতে পারে।

৪০টিরও বেশি দেশ এখন পর্যন্ত এই অ-বাধ্যতামূলক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, তবে চীন এই তালিকায় নেই।

কারো কারো মতে চন্দ্রাভিযানের নতুন নিয়মগুলো কোনো নির্দিষ্ট দেশের একার দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত নয়।

আরো..