আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বেশ কিছুদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। সম্প্রতি সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলার জেরে ইসরায়েলে হামলা চালায় ইরান। এরপর শুক্রবার পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে ইরানে। এই হামলা কারা করেছে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলছে না ইরান ও ইসরায়েল। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে— যাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো হাত নেই। এমন পরিস্থিতিতে কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব, তা নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই বিশ্বনেতাদের। কিন্তু ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা এই হামলার ঘটনাকে গুরুত্বহীন, ছোট এবং বাচ্চাদের খেলাধুলার সাথে তুলনা করে রীতিমতো হাস্যরসও করেছেন।
ইসফাহানে হামলায় কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল এবং তাতে ক্ষয়ক্ষতি কেমন হয়েছে তা নিয়ে এখনও অসম্পূর্ণ ও পরস্পরবিরোধী তথ্য আসছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা। আর ইরানের কর্মকর্তারা বলছেন, মধ্যাঞ্চলীয় ইসফাহান প্রদেশের এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিযে তিনটি ছোট ড্রোন বিস্ফোরিত হয়েছে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান দেশটির আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিমকে বলেছেন, ‘‘ভূপাতিত করা মাইক্রো এয়ার ভেহিক্যালের কারণে কোনও ক্ষয়ক্ষতি কিংবা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।’’
কিন্তু এসব সাধারণ কোয়াডকপ্টার হলো ইসরায়েলের এক ধরনের কলিং কা; যা তারা ইরানের অভ্যন্তরে গোপন কার্যক্রম চালাতে কয়েক বছর ধরে ব্যবহার করছে। এবার তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিলো ইসফাহান, যেখানে দেশটির চমৎকার ইসলামি ঐতিহ্য রয়েছে। তবে এই প্রদেশটির বিশেষ পরিচিতি হলো নাতাঞ্জ পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য। দ্য ইসফাহান নিউক্লিয়ার টেকনোলজি সেন্টার এবং একটি বড় ধরনের বিমান ঘাঁটি সেখানে আছে; যা গত ১৪ এপ্রিল ইসরায়েলে হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে।
এছাড়া এটি ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানারও একটি কেন্দ্র। সেখান থেকেই শত শত ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে গেছে ইসরায়েলের দিকে। সুতরাং সীমিত হলেও এটি ইরানের দিকে শক্ত বার্তা নিয়ে গেছে, ইরানের প্রাণকেন্দ্রে আঘাত করার মতো গোয়েন্দা সামর্থ্য ও সক্ষমতা ইসরায়েলের আছে।
ইসরায়েলের জন্য এই বার্তা দেওয়াটাই জরুরি ছিল এবং তারা সেটিই নিশ্চিত করতে চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও ইঙ্গিত দিয়েছেন, নাতাঞ্জকে সুরক্ষা দেওয়া ইরানের এয়ার ডিফেন্স রাডার সিস্টেমের মতো কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু ছিল ইসরায়েলের। তবে তা কতটা সফল হয়েছে তার কোন নিশ্চয়তা এখনও পাওয়া যায়নি।
সুতরাং হতে পারে এই হামলা ছিল একেবারেই সিরিজের প্রথম পর্বের মতো বিষয়। তবে উদ্দেশ্যমূলক না হলেও এটা ছিল ওই সময়ে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ৮৫তম জন্মদিনের উপহার। ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের নীরবতা ইরানকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক সুযোগ দিয়েছে।
আবার যখনই শত্রু আক্রমণ চালাবে তখনই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সাথে নিয়েই ইরান পাল্টা শক্ত জবাব দেবে এই নীতির দিকেও যায়নি ইরান। তারা বরং নিজেদের শক্তির প্রদর্শনকে উপভোগ করেছে।
কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি শুক্রবার দেওয়া এক বক্তৃতায় এসব সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করেননি। তিনি তার দেশের ইস্পাত কঠিন অঙ্গীকারের প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ বা সরাসরি উত্তেজনার বদলে দীর্ঘমেয়াদী খেলার কৌশলগত ধৈর্যের জন্য ইরান গর্ব করেছে।
এখন তারা কৌশলগত প্রতিরোধের কথা বলছে। নতুন এই নীতি তারা নিয়েছে দামেস্কে গত ১ এপ্রিল কূটনৈতিক কম্পাউন্ডে হামলার পর। ওই হামলায় কনস্যুলার ভবন ধ্বংস হয়েছে এবং ওই অঞ্চলে ইরানের একজন সিনিয়র কমান্ডারসহ বিপ্লবী গার্ডের সাত কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা চাপের মুখে ছিলেন। কারণ গাজা যুদ্ধে ইসরায়েল গত ছয় মাসে তাদের লক্ষ্য আরও জোরদার করেছিল।
অস্ত্র রাখার গোপন জায়গাগুলো, ভবন, ঘাঁটির মতো তেহরানের নানা স্থাপনা এবং সিরিয়া ও লেবাননের যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর সাপ্লাই রুটগুলোতেই হামলা নয়, ইসরায়েল ইরানের পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তাকেও হত্যা করেছে।
কয়েক দশকব্যাপি শত্রুতা, যার জের ধরে আগে দুই দেশের মধ্যে ছায়া যুদ্ধ ও গোপন অভিযান হতো, সেটিই এখন প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নিয়েছে। সবশেষ আঘাত-পাল্টা আঘাত যে প্রকৃতিরই হোক না কেন, উভয়পক্ষের জন্য আরও কিছু মৌলিক অগ্রাধিকার রয়েছে। যেমন, প্রতিরোধ, একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য যাতে নিজের মাটিতে আর হামলা না হয়। যদি হয় তাহলে মূল্য দিতে হবে এবং এটা হবে ক্ষতিকর।
সে কারণেই আপাতত ওই অঞ্চলে এবং কাছে ও দূরের রাজধানীগুলোতে একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস বইছে। ইসরায়েলের সবশেষ পদক্ষেপ, নিজেদের সহযোগীদের দিক থেকে সীমিত প্রতিশোধের আহ্বান, এখনকার জন্য উত্তেজনা কমিয়ে এনেছে। সবাই সর্বাত্মক যুদ্ধ বন্ধ চায়। কিন্তু এ শান্তি যে স্থায়ী হবে না; এমন সন্দেহের বাইরে কেউ নেই।
অঞ্চলটিতে এখনও আগুন জ্বলছে। গাজায় যুদ্ধ চলছে। অসংখ্য ফিলিস্তিনি হতাহতের শিকার হয়েছে। ঘনিষ্ট সহযোগীদের চাপের মুখে ইসরায়েল বড় আকারে মানবিক সহায়তার সুযোগ দিতে রাজি হয়েছে। তারপরও বিপর্যস্ত ওই ভূখণ্ডটি এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে।
হামাসের হাতে জিম্মিরা এখনও ফিরে আসেনি এবং যুদ্ধবিরতি আলোচনাতেও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ইসরায়েল হামাসের শক্ত ঘাঁটি রাফাহতে ঢোকার হুমকি দিচ্ছে। যা ত্রাণ সংস্থার প্রধান ও বিশ্বনেতারা বলছেন, আরেকটি মানবিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। পুরো অঞ্চলে ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক আছে যাকে বলা হয় ‘‘এক্সিস অব রেসিস্ট্যান্স।’’
লেবাননের হেজবুল্লাহ থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনের হুথি; সবাই প্রস্তুত। প্রতিদিনই হামলা করছে। গত কয়েক সপ্তাহে অঞ্চলটির গভীর অন্ধকার বিপজ্জনক সময়েও তার কোনও পরিবর্তন হয়নি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।