নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার তিন ইউনিয়ন যুবলীগের কমিটি আওয়ামী লীগ নেতাদের কারণে আটকে রয়েছে বলে যুবলীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা অভিযোগ তোলেছেন। এমনকি কমিটি না হওয়ায় কর্ণফুলীতে ধীরে ধীরে যুবলীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডও নিস্তেজ হয়ে পড়েছে বলে তৃণমূলের দাবি।
ফলে, দলটির নেতাকর্মীরা রয়েছেন বেকায়দায়। বছরের পর বছর ধরে দলে কোনো নতুন নেতা আসছেন না, সাবেক ছাত্রনেতারা কোন পদ পাচ্ছে না। নেই কোন পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ফলে, সংগঠনও চলছে জোড়াতালিতে।
অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব আর ক্ষমতা খর্ব হবার শঙ্কায় শিকলবাহা, বড়উঠান ও চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন যুবলীগের কমিটি ঝুঁলে আছে। দলের জন্য ত্যাগ, যোগ্যতা, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড উজ্জীবিত করার পরিবর্তে নিজেদের পদ-পদবী হয়ে উঠেছে মুখ্য বিষয়। কেন এই তিন ইউনিয়নে কমিটি হচ্ছে না-এটাই এখন পুরো উপজেলার রাজনৈতিক টপিক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালে কর্ণফুলীতে প্রথম উপজেলা যুবলীগের কমিটি হয়। এতে সভাপতি ছিলেন দিদারুল ইসলাম চৌধুরী ও সম্পাদক মো. সোলায়মান তালুকদার। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তাঁরা পদে থাকলেও পাঁচ ইউনিয়নে কোন কমিটি দিতে পারেনি। সম্ভবত তাঁদের ধারণা ছিলো, কমিটি হলে ছেলেরা বিভিন্ন গ্রুপ ও উপ-দলে বিভক্ত হবে। নিজেদের পিছনে সময় কম দেবেন। এরপর ২০১৭ সালে কর্ণফুলী যুবলীগের দায়িত্ব নেন সভাপতি পদে সোলায়মান তালুকদার ও সম্পাদক মুহাম্মদ সেলিম হক।
এরমধ্যে ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর উপজেলার ফকিরনীরহাট এলাকায় উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ফারুক চৌধুরীকে সভাপতি এবং উপজেলা যুবলীগের তৎকালিন সভাপতি ও চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোলায়মান তালুকদারকে সাধারণ সম্পাদক করা হলে যুবলীগের শীর্ষপদ খালি হয়।
এর পরপরেই হঠাৎ ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক রাজু দাশ হিরো স্বাক্ষরিত এক আদেশে কর্ণফুলী যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ঘোষণা করা হয় মিল্কভিটার পরিচালক নাজিম উদ্দিন হায়দার কে। সম্পাদক হিসেবে বহাল ছিলেন মুহাম্মদ সেলিম হক। মার্চ মাসে দায়িত্ব নিয়ে তাঁরা মে মাসেই কর্ণফুলী উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে সম্মেলন করেন।
দীর্ঘ ৯ বছর পর সম্মেলন শেষে জুলধা ও চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি কমিটি দেন। কিন্তু বাকি তিন ইউনিয়নে সম্মেলন হলেও কমিটি দিতে ব্যর্থ হন নাজিম-সেলিম পরিষদ।
তখন পাঁচ ইউনিয়নে প্রায় ৫ লক্ষ টাকার ফরম বিক্রি হয়। স্ব স্ব ইউনিয়ন সম্মেলনে সে টাকাও ব্যয় করা হয়। যদিও জুলধা-চরপাথরঘাটা যুবলীগের কমিটি দেখে তৃণমূল নেতাকর্মীরা আশার আলো দেখতে পান। ধারণা করেন সব ইউনিয়নে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। কিন্তু সম্মেলনের এক বছর অতিবাহিত হলেও এখনো তিন ইউনিয়নে কোন কমিটি হয়নি।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বর্তমান কর্ণফুলী যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বার বার কমিটি দেবার উদ্যোগ নিলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের গুটিকয়েক নেতাদের কারণে তাঁরা কমিটি দিতে পারছেন না। বিশেষ করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান তালুকদারের দিকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগের ইঙ্গিত দিচ্ছেন বেশি। যদিও সোলায়মান তালুকদার সর্বৈব অস্বীকার করেন।
শিকলবাহা ও বড়উঠান ইউনিয়নের যুবলীগের পদপ্রার্থীরা জানান, তিন ইউনিয়ন যুবলীগের কমিটি এক প্রকার চূড়ান্ত হলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার হস্তক্ষেপে তা আর প্রকাশ হয়নি। তখন ওই আওয়ামী লীগ নেতাদের অজুহাত ছিলো আগষ্ট মাস। শোকের মাস। কমিটি দেওয়া যাবে না। পরের অজুহাত ছিলো চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রীর সফর। কিন্তু এরপরও সম্ভব হয়নি। সবশেষ এলো জাতীয় নির্বাচন। ফলে, নানা ইস্যুতে তিন ইউনিয়নের কমিটি আটকে গেল।
অপর সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম জহুর বারবার কমিটি দিতে রাজি হলেও জেলা সভাপতির নীরব ভূমিকায় তিন ইউনিয়নে যুবলীগের কমিটি নিয়ে কথা বলছেন না সভাপতি দিদার।
কেননা, দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সভাপতির বাড়ি কর্ণফুলী উপজেলায়। তার উপর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সভাপতির খুব কাছের লোক হন। সুতরাং উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক চান না এখন কমিটি হোক। সভাপতিও এই আবদারে ঝিঁইয়ে রেখেছেন তিন ইউনিয়ন যুবলীগের কমিটি। এমনটাই দাবি তৃণমূলের।
ওদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্ণফুলী যুবলীগের এক নেতা জানান, যুবলীগের তৎকালীন সভাপতি সোলায়মান জুলধা ও চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে কমিটি দিতে রাজি ছিলেন না। মূলত তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগে চলে যাচ্ছেন বলে এক বছর পিছনের তারিখ দেখিয়ে দুই ইউনিয়ন যুবলীগের আংশিক কমিটি দিয়েছিলেন।
আরও তথ্য মিলে, ১৯৭২ সালের পর কর্ণফুলী পটিয়া উপজেলার অধীনে থাকলেও কখনো তৃণমূল পর্যায়ে ওয়ার্ড-ইউনিয়নের কমিটি ছিলো না। ২০২৪ সালে ইউনিয়নে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেন নাজিম-সেলিম পরিষদ। এমনকি গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম-১৩ আসনের (কর্ণফুলী-আনোয়ারা) সংসদ সদস্যের কোন প্রতিপক্ষ ছিল না। পুরো কর্ণফুলীতে যুবলীগ ছিলো একটি শক্তিশালী সংগঠন। কিন্তু বর্তমানে গুটিকয়েক আওয়ামী লীগ নেতাদের কারণে যুবলীগে ফাটল ধরেছে। বাড়ছে বিভেদ। এমনকি ব্যক্তিগত রেষারেষি দলের উপরে প্রভাব ফেলছে।
যদিও সোলায়মান-সেলিম পরিষদ একাধিক সৃজনশীল কর্মসূচি পালন করেছেন। এতে যুবলীগের কর্মশালা, টুঙ্গিপাড়া সফর, দলের আয় ব্যয়ের হিসাব, করোনাকালে ত্রাণ সহায়তা ও কেন্দ্রীয় কর্মসূচি গুলোর আয়োজন ছিলো চোখে পড়ার মতো।
জানা যায়, বিগত ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ছিল যুবলীগের ওয়ার্ড ও ইউনিয়নের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে সম্মেলন করা। তারপর উপজেলা সম্মেলন। কিন্তু দক্ষিণ জেলা যুবলীগের বাঁধার মুখে তাও সম্ভব হলো না। ফলে, দুই ইউনিয়নে কমিটি দিয়ে তিন ইউনিয়নে আটকে গেলেন নাজিম-সেলিম পরিষদ।
ফলে, কর্ণফুলীর ৪৫ টি ওয়ার্ডে তৃণমূল কমিটিও অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। এমনকি ইউনিয়ন কমিটির অভাবে করতে পারছে না সদস্য সংগ্রহ এর কর্মসুচিও। কেননা, ৭৫ হাজার টাকা ব্যয়ে পাঁচ ইউনিয়নের ৫ টি সদস্য সংগ্রহ বই নিলেও এখনো কোন আনুষ্ঠানিকতাও শুরু করতে পারেনি উপজেলা যুবলীগ।
২০২২ সালে কেন্দ্রীয় যুবলীগের পাঠানো নির্দেশ অনুযায়ী ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন কমিটি না দিতে পারলে উপজেলা কমিটির সম্মেলন করা সম্ভব হবে না বলে কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়। কারণ দুই ইউনিয়ন কাউন্সিল তালিকা করতে পারলেও বাকি তিন ইউনিয়ন সম্ভব হবে না কাউন্সিলর করা। কেননা, দলের গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে কাউন্সিল করলে একটি গ্রুপ কেন্দ্র গিয়ে অভিযোগ করতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কর্ণফুলী যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নাজিম উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেবার পর দুই ইউনিয়নে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিয়েছি। তিন ইউনিয়নে কমিটি দিতে পারছিনা নানা কারণে। আবার সে কারণও আমি ব্যাখ্যা করতে পারছিনা বলে দুঃখিত। সেই ব্যর্থতা না হয় আমার।’
যুবলীগের কমিটি দিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের নানা ইস্যু সামনে আসায় প্রশ্ন ছুঁড়া হয় কর্ণফুলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান তালুকদার মুঠোফোনে কল ও হোয়াইটঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আবিদ হোসেন বলেন, ‘এতদিন ভোটের জন্য আটকে ছিল। যেহেতু জেলা যুবলীগের সভাপতির নিজ উপজেলা কর্ণফুলী। এজন্য সবার সিদ্ধান্তে এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রীর সাথে আলাপ আলোচনা করে ঈদের পর বাকি তিন ইউনিয়নের কমিটি গুলো ঘোষণা করা হবে।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সভাপতি দিদারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘তিন ইউনিয়নের কমিটির বিষয়ে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে কথা বলতে পারেন।’ এটা বলেই ফোন লাইন বিছিন্ন করেন।