https://www.a1news24.com
২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, সকাল ১১:৫৯

কর্ণফুলীতে উপজেলা পরিষদের হরিলুট প্রকল্প, ইউএনও’র মদদে বদলি প্রকৌশলীর অনিয়ম

নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রকৌশলী মো. জাহিদুল আলম চৌধুরী’র বিরুদ্ধে বদলির পরও তড়িঘড়ি করে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিযোগ উঠেছে। এসব কাজ কোনো প্রকার টেন্ডার ছাড়াই, কোনো অনুমোদন ছাড়া সম্পূর্ণ অস্বাভাবিকভাবে চলমান বলে স্থানীয়দের নজরে এসেছে।

স্থানীয়দের আরও অভিযোগ, এসব কাজ উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন তহবিলের অর্থায়নে হয়েছে বলে কাগজে কলমে দেখাবেন তিনি পরে। কিন্তু তাঁর আগেই কাজ সম্পন্ন করে নিচ্ছেন টেন্ডার ছাড়া। যাতে বদলিজনিত কারণে অন্যত্রে যাবার আগেই বিল তুলে নিতে পারেন। প্রকল্পগুলোর বৈধতা বা কোনো ধরনের অনুমোদন নেই। এমনকি স্থানীয়দের দাবি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নীরব সমর্থনেই এসব কাজ চলছে। তবে তা স্বাধীন ভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, উপজেলা পরিষদের কমপ্লেক্সের ভেতরে একাধিক প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রতিবেদকও তার সত্যতা পেয়েছেন। ইটের গাঁথুনি দিয়ে মাটির নিচ থেকে ওয়াল নির্মাণ, অর্ধনির্মিত শহীদ মিনারের সংস্কার কাজ, সড়ক নির্মাণ এবং একটি বড় গর্ত খনন করা হচ্ছে। স্থানীয়দের ধারণা, গর্তটি সুইমিং পুলের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। এছাড়া কাজগুলোতে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

একাধিক জায়গা ঘুরে কর্মযজ্ঞ দেখে মনে হচ্ছে পাঁচটির অধিক বড়সড় প্রকল্পের কাজ চলছে। যা আরএফকিউ পদ্ধতি বিবেচনা করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার বরাদ্দ মতে নিশ্চিত ৫০ লাখ টাকার কম নয়। প্রায় অর্ধ কোটি টাকার কাজ রাতারাতি শেষ করে সম্পন্ন দেখাতে উঠেপড়ে লেগেছেন প্রকৌশলী।

এ বিষয়ে এলজিইডি কার্যালয়ের একাধিক কর্মচারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে জানান, এই কাজগুলো নিয়ম বহির্ভূত। গোপনে আরএফকিউ (রিকোয়েস্ট ফর কোয়োটেশন) দেখিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অথচ এ ধরনের প্রকল্পে নিয়মিত টেন্ডারের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া উচিত ছিল। আমাদের ধারণা, প্রকৌশলী জাহিদুল আলম বদলির আগে দ্রুত বিল উত্তোলনের চেষ্টা করছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্মাণকাজে সংশ্লিষ্ট একজন ২৩-২৪ বছরের শ্রমিক বলেন, আমরা ঠিকাদার হারুনের নির্দেশে কাজ করছি। আমাদের প্রতিষ্ঠান এইচ এন্টারপ্রাইজ। তবে কাজটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না।

এরই মধ্যে এলজিইডি থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন যে, প্রকৌশলী জাহিদুল আলম এসব কাজ দ্রুত শেষ করে বিল তুলতে চাচ্ছেন, কিন্তু কাজের কোনো অনুমোদন নেই এবং এসব কাজ টেন্ডার বা নীতিমালা অনুসরণ করে করা হচ্ছে না।

সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে জানতে সদ্য বদলি হওয়া কর্ণফুলী এলজিইডি প্রকৌশলী মো. জাহেদুল আলম চৌধুরী’র মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি। পরে অন্য সাংবাদিকদের ফোন নম্বর থেকে কল করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করে সর্বৈব অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, ‘এই তিনটি কাজ আলাদা বরাদ্দ। এসব কাজ করতেছে উপজেলা পরিষদ ভবনের কাজ করা বিভিন্ন ঠিকাদারেরা। পরিষদের ভেতরে রাস্তা, পাশে ওয়াল, এবং সুইমিং পুলের কতটাকা বরাদ্দ, কোন প্রকল্প থেকে কাজ হচ্ছে, তড়িঘড়ি করে কেন কাজ জানতে চাইলে প্রকৌশলী বলেন, ‘এটা সুইমিংপুল নয়। এই তিনটি কাজের কত টাকা বরাদ্দ মুখস্থ নেই। রবিবারে অফিসে আসেন দেখে বলব বলে কৌশলে এড়িয়ে যান প্রশ্নের উত্তর।

এলজিইডির চট্টগ্রাম বিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাসান আলী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি, এবং কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুমা জান্নাতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

তবে চট্টগ্রাম এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন বলেন, ‘এসব প্রকল্পের অর্থায়ন যদি উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন তহবিল (রাজস্ব) থেকে হয় সেক্ষেত্রে ইউএনও এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তিনি যেহেতু উপজেলা পরিষদের প্রশাসক। যদি এলজিইডির কোন বরাদ্দ হতো তাহলে নির্বাহী প্রকৌশলী স্যার জানতেন। আমি তবুও নির্বাহী প্রকৌশলীকে বিষয়টি জানাচ্ছি।’

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, ইউএনও’র নীরব ভূমিকার কারণে এসব অনিয়ম সহজেই ঘটছে। তাদের মতে, ইউএনও, যেহেতু বর্তমানে উপজেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁর নীরবতাই এই অনিয়মের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করছে।

এছাড়া, কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতির সুযোগে ইউএনও এই অবৈধ কাজগুলোর প্রতি উদাসীনতা দেখাচ্ছেন, যার ফলে প্রকৌশলী জাহিদুল আলম এসব কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার চেষ্টা করছেন।

এদিকে, এএইচ এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটর ঠিকাদার মোহাম্মদ হারুন বলেন, ‘এসব কাজ আমি করতেছি না। আমি উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা ইউএনও’র বাংলোর কাজ করতেছি। যদিও এ কাজটিও আমি পাইনি। ইজিপিতে এ কাজটি পেয়েছিলেন মূলত অন্য ঠিকাদার। আমি সাব ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতেছি।’ অথচ শ্রমিকেরা স্পষ্ট ভাবে সড়কের কাজ ও দেয়াল নির্মাণের কাজ এইচ এন্টারপ্রাইজ করতেছে বলে তথ্য দিয়েছেন।

বিশ্বস্ত সূত্র মতে, বদলি হওয়ার পরও প্রকৌশলী জাহিদুল আলম প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করে বিল উত্তোলনের পরিকল্পনা করছেন। তবে এসব প্রকল্পের অনুমোদন ছাড়াই কাজ চলতে থাকায় স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের মুঠোফোনে সমস্ত কাজের স্থিরচিত্র পাঠিয়ে অভিযোগ জানানো হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে, বিভিন্ন উৎস থেকে জানা গেছে, বিষয়টির খোঁজ খবর নিচ্ছেন এলজিইডি ও জেলা প্রশাসন। কিভাবে টেন্ডার ছাড়াই অর্থ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিংবা কোন প্রকল্প থেকে কোন প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে এসব কাজ করা হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা কতটুকু তাও খতিয়ে দেখছেন।

প্রসঙ্গত, বহুল আলোচিত ও সমালোচিত এই উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাহেদুল আলম চৌধুরীকে গত বুধবার (৮ জানুয়ারি) প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী গোপাল কৃষ্ণ দেবনাথ স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বাঁশখালী উপজেলায় বদলি করেন।

জানা গেছে, ১০ দিন আগে কর্ণফুলী থেকে বদলি হলেও এই প্রকৌশলী কর্ণফুলী ছেড়ে যাননি। উল্টো তড়িগড়ি করে কাজ গুলো বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করছেন। অথচ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে নতুন প্রকৌশলী হিসেবে পদায়িত হয়েছেন আনোয়ারা উপজেলা প্রকৌশলী তাসলিমা জাহান।

আরো..