নিজস্ব প্রতিবেদক: যারা অবৈধ উপায়ে অঢেল টাকা-পয়সার মালিক হন তাদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এত টাকা বানিয়ে লাভ কী, যে টাকার কারণে দেশ ছেড়ে ভাগতে হয়।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অর্থপাচার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। সম্প্রতি দুই দফা ভারত সফর সম্পর্কে জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিছু মানুষ লোভী হয়ে যায়। টাকা-পয়সার লোভ এত বেড়ে যায় যে, দেশ বাদ দিয়ে বিদেশে রাখতে গিয়ে পরে দেশ থেকে ভাগতে হয়। সেই অর্থ বানিয়ে লাভটা কী হলো। এতই অর্থ বানিয়ে ফেলল যে, শেষে আর দেশেই থাকা যায় না। তাহলে লাভ হয় কী? এটা তো মানুষ চিন্তা করে না।’
অর্থ পাচারকারীদের সমালোচনা করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘টাকা বানানোটা তাদের নেশার মতো পেয়ে যায় মনে হয়। এটা হলো বাস্তব কথা। তবু আমি বলব, যেখানে যেটুকু সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধানে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। তার জন্য আমরা আইনও তৈরি করেছি।’
ব্যাকিং খাতের অব্যবস্থাপনা নিয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুলের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আমলে আমরা সবচেয়ে বেশি বেসরকারি খাত খুলে দিয়েছি। হ্যাঁ, ব্যাংকিং খাতে কেউ ভালো চালাচ্ছে, কেউ খারাপ চালাচ্ছে। কোনো সময় অনেকে ঠিকমতো চালাতে পারে না। এটা চিরাচরিত নিয়ম।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যদি কোনো ব্যাংক দুর্বল হয়ে যায়, সেটাকে সহযোগিতা করা বা একটা ব্যাংকের সঙ্গে আরেকটা ব্যাংককে একীভূত করা হয়। অর্থাৎ যারা সেখানে আমানত রাখে, তাদের রক্ষা করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেটাই পালনের চেষ্টা করা হচ্ছে।’
কাউকে জেলাসি করি না, নোবেলের আকাঙ্ক্ষাও নেই
ড. ইউনূস মর্যাদাপূর্ণ নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় শেখ হাসিনা তার বিরোধিতা করেন বলে যারা অভিযোগ তোলেন তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি কাউকে ঈর্ষা করেন না। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষাও তার নেই। লবিস্ট নিয়োগের মতো অর্থ তার নেই বলেও জানান সরকারপ্রধান।
ড. ইউনূসের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তার কোম্পানির শ্রমিকরা। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। সরকার শ্রমিক অধিকার রক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক। এখানে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।
এ সময় তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় ড. ইউনূসের বিরোধিতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে আলাদা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। এই পুরস্কার নিয়ে আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। এর জন্য লবিস্ট নিয়োগ করার টাকাও নেই আমার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পর অনেক নোবেল জয়ী আমার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। ভেবে দেখেন, আমি আসার আগে কয়জন পার্বত্য চট্টগ্রাম যেতে পেরেছেন?
ড. ইউনূসের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল গঠন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে দল গঠন করতে পারে নাই। সে যদি গ্রামের মানুষকে এত কিছুই দিয়ে থাকে, তাহলে তো সেই মানুষগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। কই, কেউ তো ঝাঁপিয়ে পড়েনি।
সরকারপ্রধান বলেন, ড. ইউনূসের সাথে হিংসা করার কী আছে। সে পারলে আমার সাথে বিতর্কে আসুক। আমেরিকায় যেভাবে ডিবেট হয়, সেভাবে ডিবেট করুক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। এই জায়গায় কেউ আসতে পারবে না। আমি কারও সাথে জেলাসি করি না। আমি এর, ওর কাছে ধরনা দিয়ে বেড়াই না। দেশ বেচি না, দেশের স্বার্থও বেচি না।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকার লাগতে যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক জেনারেল এরশাদের আমলে হয়েছে। ড. ইউনূস সেখানকার এমডি ছিলেন। সেখানের শ্রমিকদের বেতন তুলতেন। বয়স ৬০ বছরের বেশি হওয়ায় তাকে ওই পদ থেকে সরে যেতে বলা হয়েছিল। তিনি সরে যাননি। সে সময় তিনি অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে হেরে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার বিরুদ্ধে মামলাও সরকার করেনি। গ্রামীণফোনের ব্যবসা আমি তাকে দিয়েছিলাম। একটি টাকাও তিনি ব্যাংককে দেননি। তিনি সব টাকা নিজের করে নিয়েছেন।
সরকারপ্রধান বলেন, শ্রমিকদের মামলায় ড. ইউনূস সাজা পোয়েছেন। ইউনূসকে উঠিয়েছিলাম আমি। এতই যদি করেছেন তবে দারিদ্র্যমুক্ত হলো না কেন। দেশে দারিদ্র্যের হার কমিয়েছি আমি।ড. ইউনূস শেখ হাসিনার হাতেই সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছেন বলেও দাবি করেন সরকারপ্রধান।
আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, বিক্রি করি না
সম্প্রতি ভারত সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সমঝোতা স্মারক সই করেছেন সেটা নিয়ে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশ বিক্রির অভিযোগ তুলেছেন। সেটার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শেখ হাসিনা দেশ বিক্রি করে না, আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। বরং যারা অভিযোগ তুলে তারাই বিক্রি হয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের ট্রেন চলাচলের বিষয়ে সমঝোতা নিয়ে যারা দেশ বিক্রির অভিযোগ তুলেছেন তাদের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কিসের মাপে দেশ বিক্রি হচ্ছে, বিক্রিটা হয় কীভাবে?’
এ সময় মুক্তিযুদ্ধের ভারতের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। মুক্তিযুদ্ধ করে এ দেশ আমরা স্বাধীন করেছি। যারা সমালোচনা করে তাদের জানা উচিত, একটি মাত্র মিত্র শক্তি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ স্বাধীনে সহযোগিতা করেছে। পৃথিবীতে যারা মিত্র শক্তি যারা যুদ্ধে সহযোগিতা করে তারা কিন্তু ওই দেশ ছেড়ে যায়নি। এখনো জাপানে আমেরিকান সৈন্য, জার্মানিতে রাশিয়ান সৈন্য আছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখানে ভারত কিন্তু ব্যতিক্রম। তারা মিত্র শক্তি হিসেবে আমাদের পাশে যুদ্ধ করে এসেছে। কিন্তু যখনই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখনই চেয়েছেন তারা (ভারতের সৈন্য) দেশে ফেরত যাক, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছেন এবং তাদের ফেরত নিয়ে গেছেন।’
বিরোধীদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এরপরও যারা কথা বলে, ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে তারা এ কথা বলে কীভাবে? আসলে যারা এ কথা বলে তারা নিজেই ভারতের কাছে বিক্রি করা। কারণ আমরা দেখেছি যখনই মিলিটারি ডিক্টেটররা (সামরিক স্বৈরাচার) এসেছে জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া ওপর দিয়ে ভারতবিরোধী কথা বলেছে, আর ভারতের পা ধরে বসে থেকেছে। এগুলো আমার নিজের দেখা, জানা।’
শেখ হাসিনা বলেন, রেলপথ ব্যবহারের ফলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হচ্ছে। ওইসব এলাকার মানুষের জন্য যোগাযোগ সহজ হচ্ছে। ইউরোপে তো বর্ডারই নেই, তারা কি তাহলে বিক্রি করে দিচ্ছে? প্রত্যেকটা দেশই তো স্বাধীন দেশ, তারা তো বিক্রি হয়নি। তাহলে সাউথ এশিয়ায় কেন এটা বাধা হয়ে থাকবে?
সরকার দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বজায় রেখেই বন্ধুত্ব করে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা উন্মুক্ত করে দিলে দেশের মানুষই উপকৃত হবে। কারণ নানা কাজে তাদের ভারতে যেতে হয়। শেখ হাসিনা জানান, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অন্য দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়। এতে দেশ বিক্রি হয়ে যায় না।
ভারত সফরকে অত্যন্ত ফলপ্রসূ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে উভয় দেশের মধ্যে পাঁচটি নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত ও বিনিময় হয়। এছাড়া তিনটি নবায়িত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত ও বিনিময় এবং দুটি রূপকল্প ঘোষণা স্বাক্ষরিত ও বিনিময় হয়। ভবিষ্যত কাজের ক্ষেত্র হিসেবে ১৩টি যৌথ কার্যক্রমের ঘোষণা দেওয়া হয়।
রাসেলস ভাইপার নিয়ে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী
সম্প্রতি দেশজুড়ে বিষাক্ত সাপ রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক শাইখ সিরাজের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জীবজন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাপ বরং মানুষকে ভয় পায়। ভয় বা আতঙ্ক থেকেই মানুষকে কামড় দিতে আসে। তাই সাপকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভয় করলে মানুষকেই করতে হয়, জীবজন্তু বা সাপকে নয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্যই জীবজন্তু। যেহেতু সাপের উপদ্রব বেড়েছে, এখন চলাফেরায় সতর্ক হতে হবে। আমি একটা বিষয়ে বিশ্বাস করি, জীবজন্তু-সাপ যাই বলেন, এরা কোনোদিন খামাখা কোনো মানুষকে আক্রমণ করে না, যদি না তারা ভীত হয়ে যায় বা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে থাকে। তাছাড়া তারা কোনোদিন কারও ক্ষতি করে না।’
নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যখন মাছ ধরতে বসি, তখন দেখি পাশ দিয়েই সাপ যাচ্ছে। একদিন দেখি আমার বসার স্থানের পাশেই একটা সাপ মুখ বের করে আছে। কই, কোনোদিন আমাকে সাপে কাটেনি তো। কোনোদিন ভয়ও পাইনি।